পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দুয়ানী কার্যক্রমের পোস্টমর্টেম -শায়খ আহমাদুল্লাহ  dawabd
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দুয়ানী কার্যক্রমের পোস্টমর্টেম -শায়খ আহমাদুল্লাহ  dawabd 
আমি আমার স্ত্রীকে তিন মাসে তিন তালাক দেই। এক্ষণে উক্ত স্ত্রীর সাথে আমার সংসার করা জায়েয হচ্ছে কি?
প্রশ্ন (১৭/২৫৭) : আমি আমার স্ত্রীকে তিন মাসে তিন তালাক দেই। পরে গ্রাম্য সালিসে আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া হয়। এক্ষণে উক্ত স্ত্রীর সাথে আমার সংসার করা জায়েয হচ্ছে কি?
-আব্দুল্লাহ, ইসলামপুর, জামালপুর। 
.
#উত্তর : উক্ত স্ত্রীর সাথে সংসার করা হারাম। কেননা তিন মাসে তিন তালাক প্রদানের মাধ্যমে তালাকটি ‘বায়েন’ তথা বিচ্ছিন্নকারী তালাকে পরিণত হয়েছে। এরপর তার পক্ষে আর পূর্ব স্বামীর কাছে ফিরে আসার সুযোগ নেই, যতক্ষণ না সে অন্যত্র স্বেচ্ছায় বিবাহ করে ও স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হয় (বাক্বারাহ ২/২২৯-৩০) । এক্ষণে তার জন্য অনতিবিলম্বে পৃথক হওয়া ও তওবা করা আবশ্যক।
monthly at tahreek
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে শরী‘আতে কোন বাধা আছে কি?
প্রশ্ন (১৬/২৫৬) : পহেলা বৈশাখ উদযাপনে শরী‘আতে কোন বাধা আছে কি? এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত মেলা থেকে কাপড়-চোপড় কেনা যাবে কি?
আবুল কালাম
কুমিল্লা।
উত্তর : ‘বৈশাখ’ উদযাপন ‘বর্ষবরণ’ প্রভৃতি অনৈসলামী প্রথা। যা থেকে মুসলিমকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন মদীনাবাসীদের দু’টি উৎসব পালন করতে দেখে তিনি তাদের বলেন, তোমাদের এ দু’টি দিন কেমন? তারা বলল, জাহেলী যুগে আমরা এ দু’দিন উৎসব পালন করতাম (অর্থাৎ সৌরবর্ষের প্রথম দিন এবং ‘মেহেরজান’ অর্থ বছরে যেদিন রাত্রি-দিন সমান হয়)। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ এ দু’দিনের পরিবর্তে দু’টি উত্তম উৎসব দান করেছেন। আর তা হ’ল ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহা’ (আবুদাঊদ হা/১১৩৪, মিশকাত হা/১৪৩৯, ‘ছালাতুল ঈদায়েন’ অধ্যায়)।
মুবারকপুরী বলেন, ‘উক্ত হাদীছ দ্বারা নবী করীম (ছাঃ) উক্ত দুই দিন ব্যতীত অন্য দিনে যাবতীয় উৎসব রহিত করেছেন এবং তার মুকাবিলায় উক্ত দু’টি দিনকে সাব্যস্ত করেছেন। মাযহার বলেন, ‘নওরোয’ (নববর্ষ) ও মেহেরজান সহ কাফিরদের অন্যান্য উৎসবকে সম্মান প্রদর্শন করা যে নিষিদ্ধ উক্ত হাদীছে তার দলীল রয়েছে’। ইবনু হাজার বলেন, ‘মুশরিকদের উৎসব সমূহে খুশী করা কিংবা তাদের মত উৎসব করা উক্ত হাদীছ দ্বারা অপসন্দনীয় প্রমাণিত হয়েছে’। শায়খ আবু হাফছ আল-কাবীর নাসাফী হানাফী বলেন, ‘এসব দিনের সম্মানার্থে মুশরিকদের যে ব্যক্তি একটি ডিমও উপঢৌকন দিল, সে আল্লাহর সাথে কুফরী করল’। কাযী আবুল মাহাসেন হাসান বিন মানছূর হানাফী বলেন, ‘এ দিনের সম্মানার্থে কেউ যদি ঐ সব মেলা থেকে কোন বস্ত্ত ক্রয় করে কিংবা কাউকে কোন উপঢৌকন দেয়, সে কুফরী করল। এমনকি সম্মানার্থে নয় বরং সাধারণভাবেও যদি এই মেলা থেকে কিছু ক্রয় করে কিংবা কাউকে এই দিন কিছু উপঢৌকন দেয়, তবে সেটিও মাকরূহ’ (মির‘আত শরহ মিশকাত, ‘ছালাতুল ঈদায়েন’ অধ্যায় ৫/৪৪-৪৫ পৃঃ)।
অতএব উক্ত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অমুসলিমদের উৎসবের সাথে মুসলমানদের কোনরূপ সম্পর্ক রাখা কিংবা সহযোগিতা করা জায়েয নয়। বৈশাখ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি মূলতঃ হিন্দুয়ানী প্রথা থেকে এসেছে। সুতরাং এ সংক্রান্ত যাবতীয় সহযোগিতা, অংশগ্রহণ, ক্রয়-বিক্রয় সহ সকল কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

ওহোদ যুদ্ধ ও মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)
২৫. মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)
ওহোদ যুদ্ধ
(৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার)

বদর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের জান নিয়ে পালিয়ে আসার গ্লানিকর তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সবশেষে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার পথ ছেড়ে নাজদের পথ ধরে সিরিয়া যাত্রী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা ছাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাষ্কর পরিণতির প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধের পুঁজি : বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলের, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালের মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহোদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। যার বিক্রয়লব্ধ মাল ও অর্থের পরিমাণ ছিল ১,০০০ উট ও ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা। এ প্রসঙ্গে সূরা আনফাল ৩৬ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয়, إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنْفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُوْنَ- আল্লাহর রাস্তা হ’তে লোকদের ফিরানোর জন্য কাফেররা যত ধনসম্পদ ব্যয় করুক না কেন, সবই ওদের মনস্তাপের কারণ হবে। ওরা পরাভূত হবে। অতঃপর কাফেররা জাহান্নামে একত্রিত হবে’ (আনফাল ৮/৩৬)
মাক্কীদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি : মুসলিম শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য তারা সাধারণ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে দিল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক বেদুঈন, কেনানা ও তেহামার অধিবাসীদের মধ্যকার যেকোন ব্যক্তি যেন এই যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীতে শরীক হয়। লোকদের উত্তেজিত ও উৎসাহিত করার জন্য দু’জন কবি আবু ‘ইযযা (أبو عزة) এবং মুসাফে‘ বিন আবদে মানাফ আল-জুমাহী (مُسافع بن عبد مناف الْجُمَحِي) -কে কাজে লাগানো হয়। প্রথমজন বদরযুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। পরে রাসূলের বিরোধিতা করবে না, এই শর্তে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি লাভ করে। তাকে গোত্রনেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসলে তাকে ধনবান করে দেবেন। অন্যথায় তার কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন’। উক্ত দুই কবি অর্থ-সম্পদের লোভে সর্বত্র যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হ’ল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়। অতঃপর যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু ওয়ালীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হ’লেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।
মদীনায় সংবাদ প্রাপ্তি :
কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর রাসূলের চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূলের হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন ক্বোবায় অবস্থান করছিলেন। হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) পত্রটি রাসূল (ছাঃ)-কে পাঠ করে শুনান। তিনি কা‘বকে পত্র প্রাপ্তির বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন ও দ্রুত মদীনায় এসে মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকে বসেন। অন্যদিকে মদীনার চারপাশে পাহারা দাঁড় করানো হ’ল। স্বয়ং রাসূলের দ্বাররক্ষী হিসাবে রাত্রি জেগে পাহারা দেবার জন্য আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয, খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ এবং উসায়েদ বিন হুযায়ের প্রমুখ আনছার নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে নিয়োজিত করলেন। চারদিকে গোয়েন্দা প্রেরণ করা হ’ল মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর নেওয়ার জন্য। গোয়েন্দাগণ মুহূর্তে মুহূর্তে রাসূলের নিকটে তাদের খবর পৌঁছে দিতে থাকেন।
পরামর্শ বৈঠকের বিবরণ : মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের উক্ত পরামর্শ বৈঠকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে নিজের দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, إني قد رأيت والله خيرًا، ‘আল্লাহর কসম! আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি’। আমি দেখি যে, কতগুলি গরু যবেহ করা হচ্ছে। দেখি যে, আমার তরবারির মাথায় কিছুটা ভগ্নদশা। আরো দেখি যে, আমার হাতখানা একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছি’। এর ব্যাখ্যা এই হ’তে পারে যে, আমার কিছু ছাহাবী এ যুদ্ধে নিহত হবে। তরবারির মাথা ভাঙ্গার অর্থ আমার পরিবারের কেউ নিহত হবেন। আর সুরক্ষিত বর্ম অর্থ মদীনা সুরক্ষিত থাকবে।
অতঃপর যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তিনি প্রথমে নিজের মত প্রকাশ করে বলেন, নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে। কেননা চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত হওয়ার কারণে আমরা সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে আছি (إنا فى جُنَّة حصينة)।’ খাযরাজ গোত্রের অন্যতম প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ বিন উবাই (মুনাফিক সর্দার) সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের এ মত সমর্থন করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে, এতে আমাদের পুরুষেরা তাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করবে এবং আমাদের মেয়েরা ও বালকেরা বাড়ীর ছাদের উপর থেকে ওদেরকে পাথর ছুঁড়ে মারবে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মদীনাতেই থাকুন। বের হবেন না। আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই শত্রুদের দিকে বের হব না। তাহ’লে তারা আমাদের কাবু করে ফেলবে’। এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ না করা এবং শত্রুদের জিতিয়ে দেওয়া। অথচ কেউ যেন সেটা বুঝতে না পারে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া এবং সর্বসমক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাওয়া।
এতে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, কপট সাথীরা সর্বদা নেতার মতের সাথে জী হুযুর বলে থাকে। পক্ষান্তরে নেতার শুভাকাংখীরা সর্বদা সতর্কভাবে নেতাকে সুপরামর্শ দেয়। তাতে তাদের নিজেদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও তারা নেতা ও সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
অতঃপর উপরোক্ত প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত তলব করলে একদল বুযর্গ ছাহাবী (جماعة من فضلاء الصحابة) , বিশেষ করে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাঁরা দ্রুত বলে উঠলেন, হে রাসূল! আমরা তো এদিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করছিলাম। আজ সেটা আমাদের কাছে এসে গেছে এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছে। অতএব اخرُج إلى أعدائنا، لا يرون أنَّا جَبُنَّا عنهم وضَعُفنا- ‘আপনি শত্রুদের দিকে বের হউন। যাতে তারা আমাদেরকে কাপুরুষ ও দুর্বল বলে ধারণা করতে না পারে’। রাসূলের চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, যিনি বদর যুদ্ধে নিজের তরবারির চমক দেখিয়েছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, والذى أنزل عليك الكتاب لا اطعم طعاما حتى أجالدهم بسيفي خارج المدينة ‘সেই সত্তার কসম! যিনি আপনার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন। আমি খাদ্য গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না আমি মদীনার বাইরে গিয়ে আমার তরবারি দ্বারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব’। আনছারদের বাকী প্রায় সবাই বললেন, আমরা জাহেলী যুগে বাইরে গিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করতাম। এখন ইসলামী যুগে আমরা বাইরে গিয়ে মুকাবিলার অধিক হকদার। অতএব শত্রুদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাঁর পূর্বমত পরিবর্তন করলেন এবং অধিকাংশের মত অনুযায়ী (رأي الأغلبية)মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর একটি জানাযা শেষে পোষাক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এতে ছাহাবীগণ লজ্জিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে বাধ্য করতে চাই না। আপনি চাইলে মদীনাতে থেকেই যুদ্ধ করুন। কিন্তু তিনি বললেন, কোন নবীর জন্য এটা সঙ্গত নয় যে, যুদ্ধের পোষাক পরিধানের পর তা খুলে ফেলেন’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বৈষয়িক ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া আমীরের জন্য সঙ্গত। এর পরেও তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। বরং তাঁর সিদ্ধান্ত সকলকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। তবে বিধানগত বিষয়ে অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া বৈধ নয়’ (আন‘আম ১১৫-১১৬)
মাক্কী বাহিনীর অবস্থান ও শ্রেণীবিন্যাস :
মাক্কী বাহিনী মহা সমারোহে বিনা বাধায় বুক ফুলিয়ে এসে মদীনার দ্বারপ্রান্তে ওহোদ পাহাড়ের সন্নিকটে মদীনার উত্তরে ‘আয়নায়েন’ (عينين) নামক স্থানে শিবির সন্নিবেশ করে। আসার পথে মদীনার উপকণ্ঠে ‘আবওয়া’ (الأبواء) নামক স্থানে পৌঁছলে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ রাসূলের আম্মা বিবি আমেনার কবর উৎপাটন করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এর ভয়ংকর পরিণতির কথা চিন্তা করে। এভাবে মাক্কী বাহিনী মদীনায় পৌঁছে যায় ৩য় হিজরীর ৬ই শাওয়াল শুক্রবার তারিখে। তাদের ডান বাহুর অধিনায়ক ছিলেন খালেদ ইবনু ওয়ালীদ এবং বাম বাহুর অধিনায়ক ছিলেন ইকরিমা বিন আবু জাহল। তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী‘আহ এবং পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ছাফওয়ান ইবনু উমাইয়া। আবু সুফিয়ান ছিলেন সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মধ্যভাগে অবস্থান নেন।
ইসলামী বাহিনীর বিন্যাস ও অগ্রযাত্রা :
দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে মাক্কী বাহিনীর যাবতীয় খবর রাসূলের নিকটে পৌঁছে যায়। তিনি তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ত্বরিৎ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ৬ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ আছর রওয়ানা করেন। ইতিপূর্বে তিনি জুম‘আর খুৎবায় লোকদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ়তার উপদেশ দেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাত লাভের সুসংবাদ শুনান। অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে তিনি মদীনার দায়িত্বে রেখে যান, যাতে তিনি মসজিদে ছালাতের ইমামতি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর এক হাযার ফৌজকে মুহাজির, আউস ও খাযরাজ- তিন বাহিনীতে ভাগ করেন। ঐ দিন যুদ্ধের পতাকা ছিল কালো রংয়ের। তিনি মুহাজির বাহিনীর পতাকা দেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর হাতে। তিনি শহীদ হবার পর দেন আলী (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা দেন উসায়েদ বিন হুযায়ের-এর হাতে এবং খাযরাজদের পতাকা দেন হাবাব ইবনুল মুনযির-এর হাতে। এক হাযারের মধ্যে ১০০ ছিলেন বর্ম পরিহিত। রাসূল (ছাঃ) উপরে ও নীচে দু’টি লৌহবর্ম পরিধান করেন। অশ্বারোহী কেউ ছিলেন কি-না এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
আল্লাহ তাঁকে শত্রু থেকে রক্ষা করবেন (মায়েদাহ ৬৭) এটা জেনেও তিনি এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন স্বীয় উম্মতকে এটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সকল কাজে দুনিয়াবী রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করতে হবে।
মদীনা থেকে বাদ আছর আউস ও খাযরাজ নেতা দুই সা‘দকে সামনে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে ‘শায়খান’ (الشيخان) নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় সেনাবাহিনী পরিদর্শন করেন। বয়সে কম ও অনুপযুক্ত বিবেচনা করে তিনি দশজনকে বাদ দেন। এরা ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন ওমর, উসামাহ বিন যায়েদ, উসায়েদ বিন যুহায়ের, (أسيد بن ظهير) যায়েদ বিন ছাবেত, যায়েদ বিন আরক্বাম, আরাবাহ বিন আউস (عرابة بن اوس), আমর ইবনু হাযম, আবু সাঈদ খুদরী, যায়েদ বিন হারেছাহ আনছারী এবং সা‘দ ইবনু হিববাহ (سعد بن حبة)। ১৫ বছর বয়স উত্তীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও রাফে‘ বিন খাদীজ এবং সামুরাহ বিন জুনদুবকে নেওয়া হয়। এর কারণ ছিল এই যে, দক্ষ তীরন্দায হিসাবে রাফে‘ বিন খাদীজকে নিলে সামুরাহ বলে উঠে যে, আমি রাফে‘ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। আমি তাকে কুস্তিতে হারিয়ে দিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুযোগ দিলে সত্য সত্যই তিনি কুস্তিতে জিতে যান। ফলে দু’জনেই যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি পান। এর মাধ্যমে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ পরিমাপ করা যায় এবং এটাও প্রমাণিত হয় যে, জিহাদের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং দৈহিক শক্তি এবং আনুষঙ্গিক প্রস্ত্ততি আবশ্যক।
ইতিপূর্বে ছানিয়াতুল বিদা‘ (ثنية الوداع) পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী দেখতে পেয়ে তাদের সম্পর্কে জানতে চান। সাথীরা বললেন যে, ওরা আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যাবার জন্য বেরিয়েছে। ওরা খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনু ক্বায়নুক্বার ইহুদী। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন (فأبى أن يستعين بأهل الكفر على أهل الشرك)। এখানে কুরায়েশকে মুশরিক এবং ইহুদীদেরকে তিনি ‘কাফের’ বলে অভিহিত করেন। অবশ্য কুরআনে কুরায়েশ দলকে ‘কাফির’ বলা হয়েছে’ (আনফাল ৩৬)। মূলতঃ শেষনবীকে অস্বীকার করায় দু’টি দলই কাফের। আর পরিণতির দিক দিয়ে কাফির ও মুশরিক সমান।
শায়খানে সন্ধ্যা নেমে আসায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনকে পাহারায় রেখে বাকী সবাই ঘুমিয়ে যান। শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর ছালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনী দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ৩০০ জনকে অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনা দলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে, ما ندري علام نقتل أنفسنا ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, إن الرسول صلى الله عليه وسلم ترك رأيه وأطاع غيره- ‘রাসূল (ছাঃ) তার কথা পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’। অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টি করা, যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী খতম হয়ে যাবে ও তার জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী সংগঠনে ফাটল সৃষ্টিকারী মুনাফিক ও সুবিধাবাদী নেতাদের চরিত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরূপই হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের পশ্চাদপসারণ দেখে আউস গোত্রের মধ্যে বনু হারিছাহ এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বনু সালামারও পদস্খলন ঘটবার উপক্রম হয়েছিল এবং তারাও মদীনায় ফিরে যাবার চিন্তা করছিল। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাদের চিত্ত চাঞ্চল্য দূরীভূত হয় এবং তারা যুদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এ দু’টি দলের প্রতি ইঙ্গিত করেই সূরা আলে ইমরান ১২২ আয়াত নাযিল হয়, إِذْ هَمَّت طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ- ‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ ছিলেন তাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই যেন বিশ্বাসীগণ নির্ভর করে’ (আলে ইমরান ৩/১২২)। এ সময় মুনাফিকদের ফিরানোর জন্য হযরত জাবিরের পিতা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারাম তাদের পিছে পিছে চলতে থাকেন ও বলতে থাকেন যে, تعالوا قاتلوا في سبيل الله أو ادفعوا-   ‘এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর’। কিন্তু তারা বলল, لو نعلم أنكم تقاتلون لم نرجع ‘যদি আমরা জানতাম যে, তোমরা প্রকৃতই যুদ্ধ করবে, তাহ’লে আমরা ফিরে যেতাম না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ তাদের বলেন, أبعدكم الله أعداء الله، فسيغني الله عنكم نبيه- ‘দূর হ আল্লাহর শত্রুরা। সত্বর আল্লাহ তাঁর নবীকে তোদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করবেন’। এ প্রসঙ্গেই সূরা আলে ইমরান ১৬৬-৬৭ আয়াত নাযিল হয় যেখানে বলা হয়, وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ، وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُواْ، ‘এর দ্বারা তিনি মুমিনদের বাস্তবে জেনে নেন’ ‘এবং মুনাফিকদেরও জেনে নেন’ (আলে ইমরান ৩/১৬৬-৬৭)। অর্থাৎ মুনাফিকদের উক্ত জওয়াব ছিল কেবল মুখের। ওটা তাদের অন্তরের কথা ছিল না। এভাবেই আল্লাহ মুসলিম সেনাদলকে ইহুদী ও মুনাফিক থেকে মুক্ত করে নেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৭০০ সেনাদল নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওহোদের দিকে অগ্রসর হন। এ সময় এক অন্ধ মুনাফিক মারবা‘ ইবনু ক্বাইযী (مربع بن قيظي) -এর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে গেলে সে মুসলিম বাহিনীর মুখের দিকে ধূলো ছুঁড়ে মেরে রাসূলের উদ্দেশ্যে বলে, তুমি যদি সত্যিকারের রাসূল হও, তবে তোমার জন্য আমার এ বাগানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই’। মুসলিম সেনারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাদের নিষেধ করে বলেন, ওকে হত্যা করো না। هذا أعمى القلب و أعمى البصر ‘সে অন্তরেও অন্ধ, চোখেও অন্ধ’।
এখানে দু’টো জিনিষ বুঝা যায় যে, ইসলামী জিহাদের প্রয়োজনে যেকোন জনপদ অতিক্রম করা যায়। এজন্য কারু অনুমতির প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়তঃ কাউকে হত্যা করা যাবে না। যতক্ষণ না সে অস্ত্র ধারণ করে হত্যায় উদ্যত হয়।
ইসলামী বাহিনীর শিবির সন্নিবেশ ও শ্রেণীবিন্যাস :
অতঃপর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেন ও সেখানে শিবির স্থাপন করেন। শত্রু সেনারা যাতে পিছন দিক হ’তে হামলা করতে না পারে, সেজন্য তিনি পূর্ব-দক্ষিণের সংকীর্ণ ও স্বল্পোচ্চ গিরিপথে আউস গোত্রের বদরী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেন। যে স্থানটি এখন ‘জাবালুর রুমাত’ (جبل الرماة) বা তীরন্দাযদের পাহাড় বলে পরিচিত। তাদেরকে বলে দেওয়া হয় যে, জয় বা পরাজয় যাই-ই হৌক না কেন, তারা যেন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান পরিত্যাগ না করে এবং শত্রুপক্ষ যেন কোনভাবেই এপথ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। এমনকি আমাদের মৃত লাশে যদি পক্ষীকূল ছোঁ মারতে থাকে, তথাপি তোমরা উক্ত স্থান  পরিত্যাগ করবে না। অথবা আমরা বিজয়ী হয়ে যদি গণীমত কুড়াতে থাকি, তথাপি তোমরা তাতে শরীক হবে না’। فلا تبرحوا حتى أرسل إليكم ‘অতএব তোমরা হটবে না, যতক্ষণ না আমরা তোমাদের ডেকে পাঠাই’। কেননা শত্রুপক্ষ পরাজিত হ’লে কেবলমাত্র এপথেই তাদের পুনরায় হামলা করার আশংকা ছিল। দূরদর্শী সেনাপতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই তাদেরকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন। তিনি পাহাড়কে আড়াল করে পিছন ও দক্ষিণ বাহুকে নিরাপদ করেন। আর যে গিরিপথ দিয়ে শত্রুপক্ষের প্রবেশের আশংকা ছিল, সেপথটি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। যাতে পরাজিত হ’লেও শত্রুপক্ষ সেখানে পৌঁছতে না পারে এবং তেমন কোন ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে তিনি শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুনযির বিন ‘আমরকে ডান পার্শ্বের এবং যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামকে বাম পার্শ্বের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদকে তার সহকারী নিয়োগ করেন। বাম বাহুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কুরায়েশ অশ্বারোহী বাহিনী ও তাদের অধিনায়ক খালেদ বিন ওয়ালীদকে ঠেকানো। তিনি বড় বড় যোদ্ধাগণকে সম্মুখ বাহিনীতে রাখেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নয়জন দেহরক্ষী নিয়ে পিছনে অবস্থান নেন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকেন।
কুরায়েশদের রাজনৈতিক চাল :
(১) যুদ্ধ শুরুর কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান আনছারদের কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান যে, তোমরা আমাদের ও আমাদের স্বগোত্রীয়দের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের থেকে সরে আসব। তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই’। কিন্তু আনছারগণ তাদের কূটচাল বুঝতে পেরে ভীষণভাবে তিরষ্কার করে বিদায় করলেন।
(২) প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কুরায়েশ পক্ষ দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করল। ইসলামের পূর্বে আউস গোত্রের অন্যতম নেতা ও পুরোহিত ছিল ‘আবু আমের’ আর-রাহিব। আউস গোত্র ইসলাম কবুল করলে সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তার ধারণা ছিল যে, সে ময়দানে উপস্থিত হ’লে আনছাররা ফিরে যাবে। সেমতে সে ময়দানে এসে আনছারদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়ে তাদেরকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হ’ল না। সংখ্যার আধিক্য ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের ব্যাপারে কুরায়েশরা কিরূপ ভীত ছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা কিছুটা অাঁচ করা যায়।
উল্লেখ্য যে, রাসূলের মদীনায় হিজরতের দিন থেকে হুনায়েন যুদ্ধ পর্যন্ত সকল রণাঙ্গনে আবু আমের আর-রাহিব মুসলমানদের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। সেই-ই ওহোদের যুদ্ধে গোপনে গর্ত খুঁড়ে রাখে। যাতে পড়ে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আহত হন এবং তিনি মারা গেছেন বলে রটিয়ে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালানো হয়। তারই চক্রান্তে ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই প্ররোচনায় রোম সম্রাট সরাসরি মদীনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা নেন। যা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচন্ড দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যেও রাসূলকে রোম সীমান্ত অভিমুখে ৯ম হিজরীতে অভিযান চালাতে হয়। যা ‘তাবূক অভিযান’ নামে পরিচিত। অবশেষে সে খৃষ্টানদের কেন্দ্রস্থল সিরিয়ায় আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অথচ তার পুত্র হানযালা ছিলেন বিখ্যাত ছাহাবী এবং ওহোদ যুদ্ধের খ্যাতিমান শহীদ ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’।
ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহর নেতৃত্বে কুরায়েশ মহিলারা বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে তুলল। এক পর্যায়ে তারা গেয়ে উঠল,
إنْ تُقْبِلوا نُعانِقْ + ونَفْرِشُ النَّمارق
او تُدْبِروا نُفارِقْ + فِراقَ غيرَ وَامِق
‘যদি তোমরা অগ্রসর হও, তবে আমরা তোমাদের আলিঙ্গন করব ও তোমাদের জন্য শয্যা রচনা করব’। ‘আর যদি তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো, তবে আমরা পৃথক হয়ে যাব তোমাদের থেকে চিরদিনের মত।’ তাতে তাদের সবাই একযোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
যুদ্ধ শুরু : ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী এবং তাদের সেরা অশ্বারোহী বীরদের অন্যতম তালহা বিন আবু তালহা আব্দুল্লাহ আল-আবদারী উটে সওয়ার হয়ে এসে প্রথমে দ্বৈরথ যুদ্ধে মুকাবিলার আহবান জানান। মুসলিম বাহিনীর বামবাহুর প্রধান যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যান এবং সিংহের মত এক লাফে উটের পিঠে উঠে তাকে সেখান থেকে মাটিতে ফেলে যবেহ করে হত্যা করেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ খুশীতে তাকবীর ধ্বনি দেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুবায়েরের প্রশংসায় বলেন, إنَّ لكل نبي حَواريًّا وحواريَّ الزبيرُ- ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নবীর একজন নিকট সহচর থাকেন। আমার সহচর হ’ল যুবায়ের’।
প্রধান পতাকাবাহীর পতনের পর তার পরিবারের আরও পাঁচ জন পরপর নিহত হয় এবং এভাবে দশ/বারো জন পতাকাবাহী মুসলিম বাহিনীর হাতে খতম হয়। যার মধ্যে একা কুযমান ৪ জনকে এবং আলী (রাঃ) ৮ জনকে হত্যা করেন। আউস গোত্রের বনু যাফর (بنو ظفر) বংশের কুযমান (قزمان) ইবনুল হারেছ ছিল একজন মুনাফিক’। সে এসেছিল নিজ বংশের গৌরব রক্ষার্থে, ইসলামের স্বার্থে নয়।
মাক্কী বাহিনীর পতাকাবাহীদের একে একে নিহত হওয়ার পর মুসলিম সেনাদল বীরদর্পে এগিয়ে যান ও মুশরিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। এই সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলকে আহবান করে বলেন, من يأخذ هذا السيف بحقه؟ কে আছ আমার এই তরবারি তার হক সহ গ্রহণ করবে? আলী, যুবায়ের, ওমর সহ বহু ছাহাবী একযোগে এগিয়ে এলেন তরবারি নেবার জন্য। কিন্তু এ সময় আবু দুজানাহ বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ তরবারির হক কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, أن تضربَ به وجوهَ العدو حتى يَنْحنى ‘তুমি এর দ্বারা শত্রুদের মুখে মারবে, যাতে ওরা আমার থেকে সরে যায়’। তখন আবু দুজানাহ বললেন, أنا آخذ بحقه يارسول الله ‘আমি এর হক আদায় করব হে আল্লাহর রাসূল’। তখন তিনি তাকেই তরবারি দিলেন। রাসূলের তরবারি হাতে পেয়ে আবু দুজানা খুশীতে আত্মহারা হয়ে মাথায় লাল পাগড়ী বেঁধে নিম্নের কবিতা বলতে বলতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যান।-
أنا الذي عاهدَنِي خليلي + ونحن بالسَّفْح لدَى النخيل
ألاَّ أقومَ الدهرَ في الكَيُّول + أضرِبُ بسيفِ الله والرسول 
‘আমরা যখন খেজুর বাগানের প্রান্তে ছিলাম, তখন আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ আমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, কখনোই আমি পিছনের সারিতে থাকবো না। বরং সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকে আল্লাহ ও রাসূলের তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষকে মারব’।উল্লেখ্য যে, বদরী ছাহাবী আবু দুজানাহ সিমাক বিন খারাশাহ আনছারী আল-খাযরাজী (রাঃ) সম্পর্কে লোকদের মধ্যে একথা প্রচলিত ছিল যে, তিনি যখন তার লাল পাগড়ীটি পরে যুদ্ধে নামেন, তখন আমৃত্যু লড়ে যান।
যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) বলেন, রাসূলের তরবারি চেয়েও না পাওয়াতে আমি দুঃখিত ছিলাম এবং শপথ করি যে, রাসূলের তরবারি দিয়ে আবু দুজানা কেমন যুদ্ধ করেন, আমি তা দেখব। তাই আমি সর্বদা তার পিছে পিছে থাকতাম। দেখলাম, তিনি শত্রুপক্ষের যাকেই সামনে পান, তাকেই শেষ করে ফেলেন। এভাবে তিনি মুশরিক সারিগুলি ছিন্ন ভিন্ন করে তীব্র গতিতে গিয়ে এমন একজনের মাথার উপরে তরবারি উঠান, যে মুশরিক সৈন্যদের দারুণভাবে উত্তেজিত করছিল। মাথার উপরে তরবারি দেখে সে হায় হায় করে উঠলে আবু দুজানা বুঝতে পারেন যে, ওটি একজন মহিলা। তখন তিনি অতি কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করেন এবং বলেন, কোন মহিলাকে হত্যা করে রাসূলের তরবারিকে কলংকিত করব না’। উক্ত মহিলা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ। বদর যুদ্ধে যার পিতা উৎবাহ, চাচা শায়বাহ, ভাই ওয়ালীদ ও পুত্র হানযালা বিন আবু সুফিয়ান নিহত হয় এবং যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি ওহোদ যুদ্ধে এসেছিলেন ও নর্তকী দলের নেতৃত্ব দিয়ে নিজ দলের সৈন্যদের উত্তেজিত করছিলেন।
এই যুদ্ধে হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের বীরত্ব ছিল কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিপক্ষের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তাঁর অস্ত্রচালনার সামনে  শত্রু পক্ষের কেউ টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর এই সিংহকে কাপুরুষের মত গোপন হত্যার মাধ্যমে শহীদ করা হয়। তাকে হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব ছিল মক্কার নেতা জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইমের হাবশী গোলাম। যার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ওয়াহ্শী ছিল বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, যা সাধারণতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ত না। মনিব তাকে বলেছিল, তুমি আমার চাচার বিনিময়ে যদি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তাহ’লে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে’। ওয়াহশী বলেন যে, আমি কেবল আমার নিজের মুক্তির স্বার্থেই যুদ্ধে আসি এবং সর্বক্ষণ কেবল হামযার পিছনে লেগে থাকি। আমি একটি বৃক্ষ বা একটি পাথরের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলাম। ইতিমধ্যে যখন তিনি আমার সম্মুখে জনৈক মুশরিক সেনাকে এক আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন এবং তাকে আমার আওতার মধ্যে পেয়ে যাই, তখনই আমি তাঁর অগোচরে তাঁর দিকে বর্শাটি ছুঁড়ে মারি, যা তাঁর নাভীর নীচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু পড়ে যান ও কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমি তার দেহ থেকে বর্শাটি বের করে নিয়ে চলে যাই’। এরপর মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের পর ওয়াহশী ত্বায়েফে পালিয়ে যান। অতঃপর সেখানকার প্রতিনিধি দলের সাথে ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে রাসূলের নিকট ইসলাম কবুল করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে ভবিষ্যতে পুনরায় সামনে আসতে নিষেধ করেন। ফলে তিনি রাসূলের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো আর মদীনায় আসেননি। আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফত কালে ভন্ড নবী মুসায়লামা কাযযাবকে ইয়ামামার যুদ্ধে ঐ বর্শা দিয়েই তিনি হত্যা করেন এবং বলেন, قد قتلتُ خيرَ الناس بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم وقد قتلتُ شَرَّ الناس، ‘আমি রাসূলের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করেছিলাম। আজ আমি নিকৃষ্টতম মানুষটিকে হত্যা করলাম’। রোমকদের বিরুদ্ধে ইয়ারমূকের যুদ্ধেও তিনি শরীক হন। তিনি  ওছমান (রাঃ) অথবা আমীর মু‘আবিয়ার খেলাফতকালে ইরাকের হিমছে বসবাস করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওহোদ যুদ্ধে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক শত্রু সেনাকে হত্যা করেন। কেবল আবু দুজানা ও হামযা নয়, অন্যান্য বীরকেশরী ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্বের সম্মুখে কাফির বাহিনী কচুকাটা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি তারা তাদের সেনা শিবির ছেড়ে সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, মুশরিক বাহিনীর মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল। তাদের নারীরা পায়ের গোছা বের করে ছুটতে লাগল। মুসলিম বাহিনী তাদের পিছনে তরবারি নিয়ে ধাওয়া করল। অতঃপর সবাই তাদের পরিত্যক্ত মালামাল জমা করতে শুরু করল।
তীরন্দাযদের ভুল ও তার খেসারত :
কাফিরদের পলায়ন ও গণীমত জমা করার হিড়িক দেখে গিরিপথ রক্ষী তীরন্দায দল ভাবল, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অতএব আর এখানে থাকার কি প্রয়োজন? গণীমতের মাল ও দুনিয়ার লোভরূপী শয়তান সাময়িকভাবে তাদের মাথায় চেপে বসল। ‘গণীমত’ ‘গণীমত’ (الغنيمة الغنيمة) বলতে বলতে তারা ময়দানের দিকে ছুটে চলল। অধিনায়ক আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের (রাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ১০ জন বাদে বাকী ৪০ জনের সবাই ছুটলো ময়দানের দিকে। শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর ধুরন্ধর সেনাপতি খালেদ ইবনু ওয়ালীদ সুযোগ বুঝে নক্ষত্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঐ ক্ষুদ্র বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ও তাঁর সাথীগণ সকলে প্রাণপণ লড়াই করে শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর খালেদ ও তার পশ্চাদবর্তী কুরায়েশ সেনাদল অতর্কিতে এসে অপ্রস্ত্তত মুসলিম সেনাদলের উপরে হামলা করল। ঐ সময় আমরাহ বিনতে আলক্বামা (عمرة بنة علقمة الحارثية) নাম্মী জনৈকা কুরায়েশ মহিলা তাদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা তুলে ধরলে চারদিক থেকে মাক্কী বাহিনী পুনরায় ময়দানে ছুটে আসে এবং অগ্র-পশ্চাৎ সবদিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। শুরু হ’ল মহা পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে মহা বিপর্যয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সময় আহত হন। অতঃপর সুকৌশলে স্বীয় বাহিনীকে উচ্চভূমিতে তাঁর ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ফলে মুসলিম বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও সাক্ষাৎ পরাজয় থেকে বেঁচে যায়। তীরন্দাযদের ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত বিজয় এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
জয়-পরাজয় পর্যালোচনা :
ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রথম দিকে বিজয়ী হয় এবং শত্রু বাহিনী ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তীরন্দাযগণের মারাত্মক ভুলের কারণে অরক্ষিত গিরিসংকট দিয়ে শত্রুবাহিনী অতর্কিতে ময়দানে ঢুকে পড়ে। যাতে মুসলিম বাহিনী চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে আহত হন। তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হয়। এছাড়া মুসলিম বাহিনীর সর্বমোট ৭০ জন শাহাদাত বরণ করেন। যার মধ্যে মুহাজির ৪ জন, ইহুদী ১ জন, বাকী ৬৫ জন আনছারের মধ্যে আউস গোত্রের ২৪ জন ও খাযরাজ গোত্রের ৪১ জন ছিলেন। কুরায়েশ বাহিনীর নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন  ২২ জন, কেউ বলেছেন ৩৭ জন। কিন্তু এ হিসাব মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তারাই বলছেন যে, একা হামযা (রাঃ) ৩০ জনের অধিক শত্রু সৈন্য খতম করেছেন। তাছাড়া আলী (রাঃ) হত্যা করেছেন ৮ জনকে, কুযমান হত্যা করেছেন ৮ জনকে। এতদ্ব্যতীত যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম, মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, আবু দুজানা, আবুবকর, ওমর, আছেম বিন ছাবেত, হাতেব ইবনু আবী বালতা‘আহ, আবু তালহা, উম্মে ‘উমারাহ, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ, মুছ‘আব বিন উমায়ের, উসায়েদ বিন হুযায়ের, হাববাব ইবনুল মুনযির, সা‘দ বিন মু‘আয, সা‘দ বিন ওবাদাহ, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ, সা‘দ ইবনু রাবী‘, নযর ইবনু আনাস, আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, হানযালাহ, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ও তাঁর পিতা ইয়ামান, আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালিক ইবনু সিনান, জাবের-এর পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম, হারিছ ইবনু ছম্মাহ, উছায়রিম, মুখাইরীক্ব, আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ, রাফে‘ বিন খাদীজ, সামুরাহ বিন জুনদুব, মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ, ক্বাতাদাহ ইবনু নু‘মান, আনাস ইবনু নাযার, ছাবিত ইবনু দাহদাহ ও তার সঙ্গীরা, আব্দুর রহমান ইবনু ‘আউফ, সাহল ইবনু হুনায়েফ প্রমুখ বীর যোদ্ধাদের হাতে কত শত্রু সৈন্য খতম হয়েছে, তার হিসাব কোথায়? তিন হাযারের দুর্ধর্ষ কুরায়েশ বাহিনী কোনরূপ চরম মূল্য না দিয়েই কি ময়দান ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছিল? অতএব মুসলিম বীরদের হাতে তাদের যে অগণিত সৈন্য হতাহত হয়েছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়।
দ্বিতীয়তঃ কুরায়েশ বাহিনী বিজয়ী হ’লে মুসলিম বাহিনীর ঘাঁটি দখল করল না কেন? তাদের মালামাল লুট করল না কেন? তারা মদীনার উপরে চড়াও হ’ল না কেন? সে যুগের প্রথানুযায়ী বিজয়ী দল হিসাবে তারা সেখানে ৩ দিন অবস্থান করল না কেন? কেন একজন মুসলিম সৈন্যও তাদের হাতে বন্দী হ’ল না? অথচ কাফের বাহিনীর দু’জন কবির অন্যতম আবু ‘ইযযাহ মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয় এবং ইতিপূর্বে বদরের যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর মুক্তিপণ হিসাবে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করায় তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। অতএব এটাকে ‘অমীমাংসিত যুদ্ধ’ বলা চলে। তবে আখেরাতের হিসাবে মুসলমানেরা সর্বদাই লাভবান এবং তারাই বিজয়ী। এদিকে  ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَهِنُوْا فِي ابْتِغَاءِ الْقَوْمِ إِنْ تَكُوْنُوْا تَأْلَمُوْنَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُوْنَ كَمَا تَأْلَمُوْنَ وَتَرْجُوْنَ مِنَ اللهِ مَا لاَ يَرْجُوْنَ وَكَانَ اللهُ عَلِيْماً حَكِيْمًا- ‘শত্রুদলের পশ্চাদ্ধাবনে তোমরা শৈথিল্য প্রদর্শন করো না। যদি তোমরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাক, তবে তারাও আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে যেমন তোমরা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছ। (তবে পার্থক্য এই যে,) তোমরা আল্লাহর নিকট থেকে (জান্নাত) আশা কর, যা তারা আশা করে না। আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১০৪)
যুদ্ধশেষে  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐদিনই অর্থাৎ ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সন্ধ্যায় মদীনায় ফিরে আসেন। কিন্তু কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় হামলা করতে পারে এই আশংকায় পরদিন ৮ই শাওয়াল রবিবার তাদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করেন কেবলমাত্র ঐসব সেনাদের নিয়ে যারা আগের দিন ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হয়। তবে সঙ্গত কারণে জাবের বিন আব্দুল্লাহকে অনুমতি দেন এবং ৮ মাইল দূরে গিয়ে ‘হামরাউল আসাদ’ (حمراء الأسد) নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন ও চারদিন পর ১২ই শাওয়াল ফিরে আসেন।
ঘটনা ছিল এই যে, এখানে পৌঁছে মা‘বাদ বিন আবী মা‘বাদ আল-খুযাঈ নামক জনৈক ব্যক্তি মুসলমান হন। তিনি রাসূলের হিতাকাংখী ছিলেন। তাছাড়া বনু হাশেম ও বনু খুযা‘আহর মধ্যে পূর্ব থেকেই মৈত্রী চুক্তি ছিল। তিনি রাসূলের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আবু সুফিয়ানের নিকট গমন করেন। আবু সুফিয়ানের বাহিনী তখন মদীনা থেকে ৩৬ মাইল দূরে ‘রাওহা’ (الروحاء) নামক স্থানে অবতরণ করেছে। কিন্তু তখন সাথীদের চাপে আবু সুফিয়ান পুনরায় মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। এমন সময় মা‘বাদ সেখানে পৌঁছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে রাসূলের পশ্চাদ্ধাবন বিষয়ে অবহিত করেন ও তাকে দারুনভাবে ভীত করে ফেলেন। এমনকি বলেন যে, মুহাম্মাদের বিরাট বাহিনী টিলার পিছনে এসে গেছে। তোমরা এখুনি পালাও। আবু সুফিয়ান তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতেন না। ফলে তার কথায় বিশ্বাস করলেন ও দ্রুত মক্কায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে মা‘বাদকে বলে দিলেন যে, তুমি মুহাম্মাদকে জানিয়ে দিয়ো যে, আমরা অতি সত্বর পুনরায় তাদের উপর হামলা করব এবং তাকে ও তার সাথীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলব’। মা‘বাদ রাযী হলেন। অতঃপর তিনি রাসূলের নিকট এসে উক্ত খবর জানালে মুসলিম বাহিনীর ঈমানী তেজ আরো বেড়ে যায় এবং তারা বলে ওঠেন, حسبنا الله ونعم الوكيل ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।
অন্য দিকে আবু সুফিয়ানের গুপ্তচর মু‘আবিয়া বিন মুগীরাহ বিন আবুল ‘আছ যে ব্যক্তি উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নানা ছিল, মদীনায় পৌঁছে তার চাচাতো ভাই ওছমান (রাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নেয়। ওছমানের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে তিন দিনের জন্য অনুমতি দেন এবং বলেন, এর পরে পাওয়া গেলে তাকে হত্যা করা হবে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা ছেড়ে গেলে সে গোপন সংবাদ সংগ্রহে লিপ্ত হয় এবং ৪দিন পর রাসূল (ছাঃ) ফিরে আসার সাথে সাথে পালিয়ে যায়। তখন তিনি যায়েদ বিন হারেছাহ ও আম্মার বিন ইয়াসিরকে পাঠান এবং তার পিছু ধাওয়া করে তাকে পাকড়াও করে হত্যা করেন। এভাবে ওহোদ যুদ্ধের পরবর্তী চক্রান্ত সমূহ শেষ করে দিয়ে রাসূল (ছাঃ) নিশ্চিন্ত হন।
ওহোদ যুদ্ধের বিষয়ে কুরআন :
ওহোদ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের ১২১ হ’তে ১৭৯ পর্যন্ত পরপর ৬০টি আয়াত নাযিল হয়। যার মধ্যে  যুদ্ধের এক একটি পর্বের আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর ঐসব কারণগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলির ফলে মুসলিম বাহিনী মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেখানে মুনাফিকদের অপতৎপরতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর যুদ্ধের ফলাফল ও এর অন্তর্নিহিত গুঢ় রহস্যের উপরে আলোকপাত করে বলা হয়েছে, مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلَى مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىَ يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ-‘নাপাককে পাক হ’তে পৃথক করে না দেয়া পর্যন্ত আল্লাহ এমন নন যে, ঈমানদারগণকে সে অবস্থাতেই ছেড়ে দিবেন, যে অবস্থায় তোমরা আছ। আর আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানাবেন...’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)
অর্থাৎ মুনাফিকদের পৃথক করা ও মুমিনদের ঈমানের দৃঢ়তা পরখ করা ছিল এ যুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আর একথাগুলি অহীর মাধ্যমে না জানিয়ে বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়াই ছিল ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের অন্যতম তাৎপর্য।
ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের রহস্য :
ইবনু হাজার বলেন, বিদ্বানগণ বলেন যে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ নিহিত ছিল। যেমন- (১) রাসূলের অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে মুসলমানদের হুঁশিয়ার করা। কেননা তীরন্দাযগণের অবাধ্যতার ফলে আকস্মিক এই বিপর্যয় নেমে আসে (২) রাসূলগণের জন্য সাধারণ নিয়ম এই যে, তারা প্রথমে বিপদগ্রস্থ হন এবং শেষে বিজয়ী হন। কেননা যদি তাঁরা সর্বদা কেবল বিজয়ী হ’তে থাকেন, তাহ’লে মুমিনদের মধ্যে এমন লোকও ঢুকে পড়বে, যারা তাদের নয়। আবার যদি তারা কেবল পরাজিত হ’তেই থাকেন, তাহ’লে রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হাছিল হবে না। সেকারণ জয় ও পরাজয় দু’টিই একত্রে রাখা হয়, যাতে প্রকৃত ঈমানদার ও কপট বিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। (৩) কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য দেরীতে আসলে মুমিনদের হৃদয়ে অধিক নম্রতার সৃষ্টি হয় এবং অহংকার  চূর্ণ হয়।  তারা  অধিক  ধৈর্যশীল হয়। পক্ষান্তরে মুনাফিকগণ দিশেহারা হয়। (৪) আল্লাহ মুমিন বান্দাদের জন্য জান্নাতে উচ্চ মর্যাদার এমন স্তর সমূহ নির্ধারণ করেছেন, যেখানে পৌঁছানোর জন্য তাদের আমল সমূহ যথেষ্ট হয় না। তখন আল্লাহ তাদের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা ও বিপদাপদ সমূহ নির্ধারণ করেন। যাতে তারা সেখানে পৌঁছতে পারেন। (৫) আউলিয়াগণ অর্থাৎ আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের জন্য সবচেয়ে বড় মর্যাদা হ’ল শাহাদাত লাভ করা। সেকারণ আল্লাহ তাদের নিকটে সে সুযোগ পৌঁছে দেন। (৬) আল্লাহ তার শত্রুদের ধ্বংস করতে চান। সেকারণ তিনি এমন কার্যকারণ সমূহ নির্ধারণ করে থাকেন, যা তাদের কুফরী, সীমালংঘন ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে রূপ লাভ করে। এর দ্বারা তিনি মুমিনদের গোনাহ সমূহ দূর করে দেন ও কাফির-মুনাফিকদের সংকুচিত ও ধ্বংস করেন।১০
বলা বাহুল্য যে, উপরোক্ত রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ কেবল ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুমিনগণের জন্যই নয়, বরং যুগে যুগে আল্লাহর পথে  জীবন উৎসর্গকারী সকল মুমিনের জন্য প্রযোজ্য।
ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আক্বীদা :
ছাহাবায়ে কেরাম নিষ্পাপ মা‘ছূম ছিলেন না। শয়তান সাময়িকভাবে হ’লেও তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে (আলে ইমরান ৩/১৫৫)। সেজন্য আল্লাহ পাক মাঝে-মধ্যে পরীক্ষায় ফেলে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেন, যেমন ওহোদের যুদ্ধে করেছেন। তবে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিয়েছেন (আলে ইমরান ৩/১৫২) এবং তাদের উপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন (তওবা ৯/১০০)। তাদের বিশাল সৎকর্ম সমূহ ছোট খাট গোনাহ সমূহকে ধুয়ে ছাফ করে নিয়ে গেছে (হূদ ১১/১১৪)। রাসূলের ভাষায় ‘ওহোদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করলেও ছাহাবায়ে কেরামের কোন একজনের (সৎকর্মের) সমপরিমাণ বা তার অর্ধেকও হবে না।১১ ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, শাম বিজয় কালে সেখানকার নাছারাগণ ছাহাবীগণকে দেখে বলেছিল, ‘আল্লাহর কসম! এঁরা আমাদের হাওয়ারীদের চাইতে উত্তম’ (هؤلاء خير من الحواريين) ইবনু কাছীর বলেন, তারা সত্য কথাই বলেছিল। কেননা ছাহাবীগণ সম্পর্কে বিগত এলাহী কিতাব সমূহেও বর্ণনা রয়েছে।১২
ওহোদ যুদ্ধের কতগুলি উল্লেখযোগ্য দিক ও শিক্ষণীয় ঘটনা
(১) ‘আব্দুল্লাহ’ নামের কাফেরগণ- 
(ক) কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী বনু আব্দুদ্দার-এর নিহত ১০ জন পতাকাবাহীর প্রথম ৬ জনের সকলেই ছিল আবু তালহা আব্দুল্লাহ বিন ওছমান ইবনু আব্দিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র।
(খ) কুরায়েশ তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বদর যুদ্ধে নিহত উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী‘আহ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে সরাসরি আঘাতকারী তিনজন কাফের সৈন্যের দ্বিতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূলের ললাট রক্তাক্ত হয়। ইনি ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিঃ)-এর দাদা। তৃতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ লায়ছী, যার আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূলের চোখের নীচে চেহারার মধ্যে ঢুকে যায়। শেষোক্ত ব্যক্তি একই সময়ে মুহাজিরগণের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে হত্যা করে এবং চেহারায় মিল থাকার কারণে তাকেই রাসূল ভেবে রাসূল নিহত হয়েছেন বলে সে সর্বত্র রটিয়ে দেয়।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন তাঁর সৈন্যদের শিবিরে ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর উপরে হামলাকারী প্রথম কাফের সৈন্যটির নাম ছিল উছমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুগীরাহ। দ্বিতীয় কাফির সৈন্যটির নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন জাবের। প্রথমজন হারেছ ইবনু ছাম্মাহর আঘাতে এবং দ্বিতীয় জন আবু দুজানার হাতে নিহত হয়। এইসব আব্দুল্লাহগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এরা আল্লাহর বিধান মানতে ও রিসালাত-এর উপরে ঈমান আনতে রাযী ছিল না। এক কথায় তারা তাওহীদে ববূরিয়াতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তওহীদে ইবাদতে বিশ্বাসী ছিল না। মুমিন হওয়ার জন্য যা অপরিহার্য শর্ত।
(২) পিতা ও পুত্র পরস্পরের বিপক্ষে :
হিজরতের পূর্বে মদীনার আউস গোত্রের সর্দার ও ধর্ম যাজক ছিল আবু আমের ‘আর-রাহেব’। হিজরতের পরে সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশদের পক্ষে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করে। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) তার লকব দেন আবু আমের ‘আল-ফাসেক্ব’। পক্ষান্তরে তার পুত্র ‘হানযালা’ ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেই তরুণ সৈন্য যিনি সবেমাত্র বিয়ে করে বাসর যাপন করছিলেন। অতঃপর যুদ্ধের ঘোষণা শুনেই নাপাক অবস্থায় ময়দানে চলে  আসেন এবং ভীষণ তেজে যুদ্ধ করে শহীদ হন। ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দেন। এজন্য তাঁকে ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ বলা হয়।
(৩) দুই ভাই পরস্পরের বিপক্ষে :
ওহোদ যুদ্ধে রাসূলের উপরে হামলাকারী তিন জনের প্রথম জন ছিল উৎবাহ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। তার নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতেই রাসূলের ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে যায়। পরে হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ) তার পিছনে ধাওয়া করেন এবং এক আঘাতেই তার মস্তক দেহচ্যুত করে ফেলেন ও তার ঘোড়া ও তরবারি দখল করে নেন। এই উৎবাহর ভাই ছিলেন ‘ইসলামে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী’ এবং মুসলিম বাহিনীর খ্যাতনামা বীর ও পরবর্তীকালে ইরাক বিজেতা সেনাপতি হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।
(৪) ওহোদ যুদ্ধে কুরায়েশ মহিলাদের তৎপরতা :
(ক) কুরায়েশ পক্ষে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ ১৫ জনের মহিলা দলের নেতৃত্ব দেন। তারা নেচে গেয়ে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করেন। যুদ্ধে আবু দুজানার তরবারির হাত থেকে হিন্দা বেঁচে যান তার হায় হায় শব্দে তাকে নারী হিসাবে চিনতে পারার কারণে। (খ) পলায়ণপর কুরায়েশ বাহিনী যখন পুনরায় অরক্ষিত গিরিপথ দিয়ে ময়দানে আবির্ভূত হয়, তখন কুরায়েশ বাহিনীর ভূলুণ্ঠিত যুদ্ধ পতাকা আমরাহ বিনতে আলক্বামাহ নাম্মী এক কুরায়েশ মহিলা অসীম বীরত্বের সাথে দ্রুত উঁচু করে তুলে ধরেন। যা দেখে বিক্ষিপ্ত ও পলায়ণরত কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে ও গণীমত কুড়ানোয় ব্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।
(৫) ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের ভূমিকা :
(ক) উম্মে আয়মন : যখন  তিনি দেখলেন যে, কুরায়েশ  বাহিনীর শেষোক্ত হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে মুসলিম বাহিনীর কেউ কেউ মদীনায় ঢুকে পড়ছে। তখন তিনি তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলেন ও বলতে লাগলেন هاكَ المغزل وهلم سيفك ‘তোমরা এই সূতা কাটার চরকা নাও এবং আমাদেরকে তরবারি দাও’। এই বলে তিনি দ্রুতগতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছেন এবং আহতদের পানি পান করাতে শুরু করেন। তার উপরে জনৈক শত্রুসৈন্য তীর চালিয়ে দিলে তিনি পড়ে যান ও বিবস্ত্র হয়ে যান’। এ দেখে আল্লাহর শত্রু হো হো করে  হেসে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছকে একটি পালকবিহীন তীর দিয়ে বলেন, এটা ওর উপরে চালাও’। সা‘দ ওটা চালিয়ে দিলে ঐ শত্রুটির গলায় বিদ্ধ হয় ও চিৎ হয়ে পড়ে বিবস্ত্র হয়ে যায় এবং রাসূল (ছাঃ) হেসে ওঠেন।
(খ) যুদ্ধ শেষে কিছু মুসলিম মহিলা ময়দানে আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা বিনতে আবুবকর, উম্মে সুলায়েম (أم سُلَيم) , উম্মে সুলাইত্ব (أم سُلَيط) প্রমুখ ছিলেন। যারা পিঠের উপরে মশক বহন করে এনে আহত সৈনিকদের পানি পান করান।১৩
(গ) যুদ্ধ শেষে ঘাঁটিতে স্থিতিশীল হওয়ার পর কন্যা ফাতিমা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যখম ধুয়ে ছাফ করেন এবং জামাতা আলী তার ঢালে করে পানি এনে তাতে ঢেলে দেন। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, তাতে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। তখন ফাতিমা (রাঃ) চাটাইয়ের একটা অংশ জ্বালিয়ে  তার ভস্ম ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। তাতে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।১৪ এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন, নূরের নবী নন। তাছাড়া এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, চিকিৎসা গ্রহণ করা নবীগণের মর্যাদার বিরোধী নয়।
(ঘ) উম্মে উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব যিনি ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত আক্বাবায়ে কুবরায় শরীক ছিলেন, তিনি অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আহতদের সেবা-শুশ্রূষায় রত ছিলেন। যখন শুনলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কাফেরদের মধ্যে ঘেরাও হয়েছেন তখন ছুটে এসে বীর বিক্রমে কাফেরদের প্রতি তীর বর্ষণ শুরু করেন। রাসূলকে আঘাতকারী ইবনু ক্বামআহকে তিনি তরবারি দ্বারা কয়েকবার আঘাত করেন। কিন্তু লৌহ বর্মধারী হওয়ায় সে বেঁচে যায়। পাল্টা তার আঘাতে উম্মে উমারাহ দারুণভাবে আহত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ঐ বিপদের সময়ে আমি ডাইনে-বামে যেদিকে তাকাই সেদিকেই উম্মে উমারাহকে দেখি, আমাকে রক্ষা করার জন্য তিনি অবিরাম গতিতে যুদ্ধ করে চলেছেন’। ঐ দিন উম্মে উমারাহর দেহে ১২টি যখম লেগেছিল।
৬। ফেরেশতারা যাঁকে গোসল দিলেন :
যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা শুনেই বাসর ঘর ছেড়ে ত্বরিৎ গতিতে যুদ্ধের ময়দানে এসে শত্রুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন সদ্য বিবাহিত যুবক হানযালা বিন আবু আমের আর-রাহিব। অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনি শত্রু বাহিনীর সারিগুলি তছনছ করে মধ্যভাগে পৌঁছে যান। অতঃপর কুরায়েশ সেনাপতি আবু সুফিয়ানের মাথার উপরে তরবারি উত্তোলন করেন তাকে খতম করে দেবার জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তে শত্রুসৈন্য শাদ্দাদ বিন আউসের আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হন ও শাহাদাত বরণ করেন।
যুদ্ধশেষে হানযালার মৃত দেহ অদৃশ্য ছিল। অনেক সন্ধানের পর এক স্থানে এমন অবস্থায় পাওয়া গেল যে, যমীন হ’তে উপরে রয়েছে এবং ওটা হ’তে টপটপ করে পানি পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে বললেন, ‘ফেরেশতারা তাকে গোসল দিচ্ছেন’। পরে তার স্ত্রীর কাছে প্রকৃত ব্যাপারটি জানা যায় যে, তিনি নাপাকীর গোসল ছাড়াই যুদ্ধের ময়াদনে ছুটে এসেছিলেন। ফলে তখন থেকে হযরত হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ (غسيل الملائكة) বা ‘ফেরেশতাগণ কর্তৃক গোসলকৃত’ বলে অভিহিত হন।
৭। নিজেদের হাতে নিজেদের মৃত্যু :
খালেদ বিন ওয়ালীদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দু’ধরনের লোকের সৃষ্টি হয়। একদল কাফিরদের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে জান বাঁচানোর জন্য কেউ পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে। কেউ পাহাড়ের মাথায় উঠে পড়ে এবং অন্যদল শত্রু সেনাদের মধ্যে মিশে যায়। ফলে পরস্পরকে চিনতে ব্যর্থ হয়ে মুসলমানের হাতেই কোন কোন মুসলমান শহীদ হয়ে যান। এমনই অবস্থার শিকার হন খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর বৃদ্ধ পিতা হযরত ইয়ামান (রাঃ)। এ সময় হুযায়ফা চীৎকার দিয়ে বলেন, أي عباد الله أبي أبي ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমার পিতা, আমার পিতা! কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি।১৫ তখন হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, يغفر الله لكم وهو أرحم الراحمين ‘আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন! তিনি শ্রেষ্ঠ ক্ষমাকারী’।১৬ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে তার পিতার রক্তমূল্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা না নিয়ে মাফ করে দেন।
৮। মুশরিকদের বেষ্টনীতে রাসূল (ছাঃ); সাথী মাত্র নয়জন জান কোরবান ছাহাবী :
যুদ্ধ চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নয় জন সাথী সহ সেনাবাহিনীর পিছনে থেকে সৈন্য পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পান যে, সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে খালেদ বিন ওয়ালীদ সসৈন্যে ঢুকে পড়ছে। তখন তিনি সাক্ষাত বিপদ বুঝতে পেরে নিজে আত্মরক্ষা করে শিবিরের দিকে না গিয়ে চীৎকার দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ডাক দিলেন ‘হে আল্লাহর বান্দারা এদিকে’ (إلىّ عباد الله، إلىّ عباد الله) বলে। এতে মুশরিক বাহিনী তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চারদিক থেকে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, من يردهم عنا وهو رفيقي في الجنة ‘যে ব্যক্তি আমাদের থেকে ওদের হটিয়ে দেবে সে ব্যক্তি আমার সাথে জান্নাতে থাকবে’ (মুসলিম)। তখন তাঁকে বাঁচানোর জন্য সাথী একে একে সাত জন আনছার ছাহাবীর সকলে জীবন দিলেন। এদের মধ্যে সর্বশেষ আনছার ছাহাবী ছিলেন উমারাহ ইবনু ইয়াযীদ ইবনুস সাকান (রাঃ)। বাকী রইলেন মাত্র দু’জন মুহাজির ছাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ এবং সা‘দ বিন আবী ওয়াক্ক্বাছ (রাঃ)।১৭ তাদের অতুলনীয় বীরত্বের মুখে কাফের বাহিনী এগিয়ে আসতে বাধাগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে কুরআন বলেছে, إِذْ تُصْعِدُوْنَ وَلاَ تَلْوُوْنَ عَلَى أحَدٍ وَالرَّسُوْلُ يَدْعُوْكُمْ فِيْ أُخْرَاكُمْ- ‘যখন তোমরা (ভয়ে পাহাড়ের) উপরে উঠে যাচ্ছিলে এবং পিছন দিকে কারু প্রতি ফিরে তাকাচ্ছিলে না, অথচ রাসূল তোমাদের ডাকছিলেন তোমাদের পিছন দিক থেকে ... (আলে ইমরান ৩/১৫৩)
৯। রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদ হ’ল :
ত্বালহা ও সা‘দ ব্যতীত যখন রাসূলের পাশে আর কেউ  নেই।১৮ তখন এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করার জন্য কাফেররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রথমে সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছের ভাই উৎবাহ বিন আবী ওয়াকক্বাছ রাসূলের চেহারা লক্ষ্য করে সজোরে পাথর নিক্ষেপ করে। তাতে রাসূলের ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁতটি ভেঙ্গে যায় ও নীচের ঠোটটি আহত হয়। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী এগিয়ে এসে তাঁর ললাটে তরবারির আঘাত করে যখম করে দেয়। এরপর আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ নামক এক দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী এসে তার কাঁধের উপরে ভীষণ জোরে তরবারির আঘাত করে। যা তাঁর লৌহবর্ম ভেদ করতে না পারলেও তার ব্যথা ও কষ্ট তিনি এক মাসের অধিক সময় অনুভব করেন। তারপর সে দ্বিতীয় বার আঘাত করে। যাতে তাঁর শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চোখের নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে থেকে যায়। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাচ্ছিল্য করে আব্দুল্লাহ বলে خذ هذا وأنا ابن قمئة ‘এটা লও। আমি ক্বামআহর (টুকরাকারিণীর) বেটা’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) তাকে বদ দো‘আ করে বলেন, أقمأك الله‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’।১৯
১০। রাসূলের উপরে হামলাকারীদের পরিণতি :
প্রথম হামলাকারী উৎবাহ বিন আবী ওয়াক্ক্বাছ যার নিক্ষিপ্ত পাথরে রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদ হয়, তার ভাই সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) এর প্রতিশোধ নিতে  চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ তার পিছে ধাওয়া করে এক আঘাতেই তার মস্তক দেহচ্যুত করে ফেলেন এবং তার ঘোড়া ও তরবারি দখল করে নেন।
দ্বিতীয় হামলাকারী আব্দুল্লাহ বিন শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূলের ললাট দেশ যখম হয়, তার পরিণতি জানা যায়নি।
তৃতীয় আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ, যার তরবারির আঘাতে রাসূলের শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে যায় এবং যাকে রাসূল (ছাঃ) ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’ বলে বদদো‘আ করেছিলেন, তার পরিণতি হয়েছিল এই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলের দো‘আ কবুল করেন এবং তার উপরে তার বকরীদের বিজয়ী করে দেন। ঘটনা ছিল এই যে, যুদ্ধ হ’তে মক্কায় ফিরে সে তার বকরী পালের খোঁজে পাহাড়ের দিকে যায় এবং তার বকরীগুলিকে পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পায়। অতঃপর সে সেখানে উঠে বকরী খেদিয়ে আনতে গেলে হঠাৎ শক্তিশালী পাঁঠা ছাগলটি তাকে শিংয়ের প্রচন্ড গুঁতা মেরে ফেলে দেয়। অতঃপর তাকে পাহাড় থেকে নীচে ফেলতে ফেলতে এবং শিংয়ের গুঁতা মারতে মারতে টুকরা টুকরা করে ফেলে।২০
১১। রাসূলের পায়ের উপরে মাথা রেখে শহীদ হ’লেন যিনি :
কাফেরদের বেষ্টনীতে পড়ে গেলে সেই সংকট মুহূর্তে সপ্তম আনছার ছাহাবী উমারাহ ইবনু ইয়াযীদ ইবনুস সাকান যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে ছাহাবায়ে কেরাম এসে পড়েন ও কাফেরদের হটিয়ে দিয়ে তাকে উঠিয়ে রাসূলের কাছে নিয়ে যান। রাসূল (ছাঃ) তার মুখমন্ডল নিজের পায়ের উপরে রাখেন। অতঃপর তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়। এটাই যেন ছিল তার মনের বাসনা যে, ‘প্রাণ যেন নির্গত হয় আপনার পদচুম্বনে’। এই ঘটনায় উর্দু কবি গেয়েছেন,

سر بوقت ذبح اپنا اس ڪے زير پائے ﮨﮯ
يه نصيب الله اكبر لوﭩنے كي جائے ﮨﮯ
‘যবহের সময় নিজের মাথা
রাসূলের পায়ের উপর
দুনিয়া হ’তে প্রস্থানকালে ‘আল্লাহু আকবর’
কতই না বড় সৌভাগ্য তার!’

[ক্রমশঃ]

ইবনু হিশাম ২/৬৩
ইবনু হিশাম ২/৬৬
বুখারী, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১/৪২৬, হা/৩০৩৯; ফাৎহুল বারী ৭/৪০৩
ইবনু হিশাম ২/৬৭-৬৮
আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৬০-৬১
ইবনু হিশাম ২/৭১-৭২
ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩; বায়হাক্বী ৯/৯৭-৯৮; ফাৎহুল বারী ৭/৪২৭
আল-ইছাবাহ, ২/২৮৬, ক্রমিক সংখ্যা ১১০২
বুখারী হা/৪০৪৩, ২/৫৭৯
১০যাদুল মা‘আদ ২/৯৯-১০৮; ফাৎহুল বারী ৭/৩৪৭ পৃঃ
১১মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৮
১২ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফাৎহ ২৯ আয়াত
১৩বুখারী হা/৪০৬৪, ২/৫৮১
১৪বুখারী হা/৪০৭৫, ২/৫৮৪
১৫বুখারী হা/৪০৬৫, ১/৫৩৯, ২/৫৮১
১৬ইবনে হিশাম ২/৮৭-৮৮; হাকেম ৩/২০২, সনদ ছহীহ
১৭মুসলিম হা/৪৬৪১, ২/১০৭
১৮বুখারী হা/৪০৬০, ২/৫৮১, ১/৫১৭
১৯ফাৎহুল বারী ৭/৪৩২, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায়, ২৪ অনুচ্ছেদ
২০ফাৎহুলবারী ৭/৪৩২

source;http://at-tahreek.com/june2011/2-1.html
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব
আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্য আরবের প্রাচীন উচ্চভূমি অঞ্চল ‘নাজদ’। অষ্টাদশ শতকে এ ভূখন্ডে ঘটে যায় এক অসাধারণ ইসলামী বিপ্লব। ইসলাম আগমনের পূর্বে অজ্ঞতার তিমির প্রহেলিকা আরবজাতিকে যেমন আচ্ছাদিত করে রেখেছিল, ঠিক তেমনি আববাসীয় শাসনামলের পতনের পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি পুনরায় খোদ ‘অহি-র অবতরণস্থল’ আরবের বুকে ধীরে ধীরে জমাট বেঁধেছিল জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিস্রা। শিরক-বিদ‘আতের ভয়াবহ আগ্রাসনে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছিল ইসলামের ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির আদিকাঠামো। এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে বলা যায় ইসলামের পুনর্জন্মবার্তা নিয়েই ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ তথা ইসলামের বিশুদ্ধ রূপের দিকে প্রত্যাবর্তনবাদী ও সংস্কার-অনুবর্তী এই আন্দোলনের জন্ম হয়। বৈশিষ্ট্যগত কারণে এ আন্দোলনকে সালাফী আন্দোলন বা মুওয়াহ্হিদীন আন্দোলন বলে আখ্যা দেয়া হয়। এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সালমান বিন আলী আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খৃঃ) রাহিমাহুল্লাহ। অহী নাযিলের পবিত্র ভূমি আরবের বুকে এই মহান যুগসংস্কারক কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের পুনরুজ্জীবনই ঘটাননি; বরং নাজদ থেকে এমন এক ইসলামী সমাজের উত্থান ঘটান যা খুলাফায়ে রাশেদীনের পর অহি-র প্রাণকেন্দ্রে পুনরায় তাওহীদ ও সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল একটি বৃহত্তর আরব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়েছিল। যার বিকীর্ণ আলোকচ্ছটা আরব মরুর দিকচক্রবাল পেরিয়ে পরবর্তীতে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
এ আন্দোলন ছিল মুসলিম বিশ্বে শিরক, বিদ‘আত অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট নবসৃষ্ট বিধি-বিধান, বিজাতীয় সংস্পর্শ থেকে আগত যাবতীয় শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম একটি সংগঠিত ও সফল আন্দোলন, যা মধ্যযুগীয় অবক্ষয়কালীন দুর্যোগ কাটিয়ে ইসলামের নবতর বিকাশের জন্য এক যুগান্তকারী মাইলফলকে পরিণত হয়। আধুনিক যুগের সকল ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের আদর্শিক প্রেরণা এই আন্দোলন। সৈয়দ আব্দুল কুদ্দূস যথার্থই বলেন, ‘আধুনিক যুগে ইসলামী রেঁনেসার উৎপত্তি মূলতঃ অষ্টাদশ শতকের ‘ওয়াহ্হাবী’ আন্দোলন থেকে। দার্শনিক ও আদর্শগত দিক থেকে এই রেঁনেসার ইতিহাস মূলতঃ ওয়াহ্হাবী আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা’। মহাকবি ইকবাল এই আন্দোলনকে আখ্যা দিয়েছেন- ‘‘The first throb of life in modern Islam" অর্থাৎ ‘আধুনিক ইসলামের প্রথম হৃদস্পন্দন’ হিসাবে। আল্লামা যিরিকলী বলেন, ‘এই দাওয়াত ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আধুনিক নবজাগরণে সর্বপ্রথম বিচ্ছুরিত আলোকধারা। যার প্রভাবে ভারত, মিসর, ইরাক ও সিরিয়ার সংস্কারবাদীগণ উদ্বুদ্ধ হন’। মুহাম্মাদ যিয়াউদ্দীন আর-রীস বলেন, ‘এ আন্দোলন এমন দু’টি মূলনীতিকে ধারণ করেছিল, মুসলিম বিশ্বের অগ্রযাত্রায় যার প্রভাব সর্বাধিক। এক. পবিত্র কুরআন ও হাদীছ- এই দু’টি মূলসূত্রের উপর নির্ভরতা এবং সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত নীতিমালার দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান ও দুই. ইজতিহাদের নীতি প্রবর্তন। এই দু’টি নীতি হ’ল মুসলিম সমাজে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক জাগরণের ভিত্তি। বলা বাহুল্য, এই দু’টি নীতি অবধারণের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হওয়া প্রাচ্যের সকল সংস্কারবাদী আন্দোলনই ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের কাছে সর্বৈব ঋণী। এ আন্দোলনের সাথে অন্যান্য সব আন্দোলন দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত, হয় সরাসরি গ্রহণের মাধ্যমে অথবা অনুসরণের মাধ্যমে, নতুবা অন্ততঃ প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে।
মুসলিম সমাজে এ আন্দোলনের প্রভাব কিরূপ ছিল সে সম্পর্কে মরক্কোর স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা প্রখ্যাত শল্যবিদ ও দার্শনিক আব্দুল করীম আল-খাত্বীব (১৯২১-২০০৮ খৃঃ) বলেন,والذي لا شك فيه، أن الدعوة الوهابية كانت أشبه بالقذيفة الصارخة، تنفجر في جوف الليل والناس نيام- كانت صوتا قويا رائدا أيقظ المجتمع الإسلامي كله، وأزعج طائر النوم المحوم علي أوطانهم منذ أمد بعيد- ‘নিঃসন্দেহে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন ছিল এক প্রচন্ড নিনাদসম্পন্ন মিসাইলের মত; যা বিস্ফোরিত হয়েছিল এক গভীর রাতের অমানিশার মাঝে, যখন মানুষ ছিল নিদ্রামগ্ন। এর আওয়াজ ছিল এমনই তীব্র ও সুদূরপ্রসারী যে তা সমগ্র মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং তা যেন সুদীর্ঘকাল পর নিদ্রাচ্ছন্ন বুভুক্ষ পাখীকে আপন বাসস্থানে চঞ্চল করে তুলেছিল’। ড. আমীনুল ইসলাম বলেন, এ আন্দোলন আরবদের শুধু আত্মসমালোচনা ও আত্মানুসন্ধানের জন্যই সজাগ করে দেয়নি, একই সঙ্গে তাদের জাগিয়ে দিয়েছে সেই মোহনিদ্রা থেকে, যা কিনা নিহিত ছিল তাদের অবক্ষয়ের মূলে। এ আন্দোলন তাদের মনে যে শক্তি ও গতি সঞ্চার করে, সেটিই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল একাধিক সংস্কারধর্মী কর্মসূচি গ্রহণে।’ ইয়াহইয়া আরমাযানী বলেন, ‘উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার দিক থেকে এ আন্দোলন ৭ম শতাব্দীতে পরিচালিত নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আন্দোলনের সাথে এমনই সাদৃশ্যপূর্ণ যে, কেউ কেউ একে ইসলামের দ্বিতীয় আবির্ভাব বলে বিবেচনা করে থাকেন। এ আন্দোলনের যুগান্তকারী প্রভাবকে খৃষ্টসমাজের প্রটেস্ট্যান্টদের উত্থানের সাথে তুলনা করে T.P.Huges বলেন, ‘ওয়াহ্হাবীজমকে কখনও কখনও ইসলামের প্রটেস্ট্যানিজম বলা হয়; আর বাস্তবিকই তাই, যদিও এখানে বড় পার্থক্য হ’ল খৃষ্টান প্রটেস্ট্যান্টরা তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলোকে যথাযথ সম্মান করলেও প্রথাগত ধর্মীয় রীতিনীতিকে স্বীকার করে না। আর ওয়াহ্হাবীজম পবিত্র কুরআনের সাথে হাদীছের শিক্ষাকেও দৃঢ়ভাবে ধারণ করে’।
বিগত দু’শত বছরের ইসলামী ইতিহাসে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অথচ ইতিহাসে এ আন্দোলন যেমন একটি ইতিবাচক সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসাবে নন্দিত হয়েছে, তেমনি শুরু থেকে অদ্যাবধি এ আন্দোলন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে একটি বড় অংশের তীব্র বিরোধিতা ও শত্রুতার শিকার হয়েছে। একদিকে একদল নামধারী মাযহাবী, পীরপন্থী আলেম-ওলামা এ আন্দোলনকে ইসলাম বহির্ভূত প্রমাণ করার জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে; অন্যদিকে পশ্চিমারা ও তাদের খুদ-কুড়ো খাওয়া এক শ্রেণীর মুসলমান তাদের ‘মুক্তবুদ্ধি’ দর্শনের জন্য বিপজ্জনক চিহ্নিত করে। এ আন্দোলনকে পশ্চাদমুখী, চরমপন্থী, মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে এর প্রভাবমুক্ত রাখার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। অধুনা পশ্চিমা বিশ্বের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যু্দ্ধে’র প্রধান টার্গেট হ’ল এই আন্দোলনের ভাবানুকূল বিশ্বের বিভিন্ন আদর্শিক আন্দোলনসমূহ। যাকে তারা ‘ওয়াহ্হাবীজম’ ও ‘সালাফীজম’ বলে আখ্যায়িত করে। এসকল প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আলোচ্য নিবন্ধে এ আন্দোলনের পরিচিতি ও মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, একে মানুষের চোখে হীনকরভাবে দেখানোর জন্য বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে এ আন্দোলনকে ‘ওয়াহ্হাবী’১০ আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা পরে ইউরোপীয়দের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায় (একই উদ্দেশ্যে এ নামটি পাক-ভারত উপমহাদেশের ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের সাথেও জুড়ে দেয়া হয়েছিল)। এতদসত্ত্বেও সমধিক প্রসিদ্ধির কারণে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে প্রচলিত এই নামটিই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
ওয়াহহাবী আন্দোলনের পরিচয় : 
নামকরণ :
আগেই বলা হয়েছে, ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ নামকরণটি এ আন্দোলনের উদ্গাতা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বা তাঁর অনুগামীদের প্রবর্তিত নয়। পরবর্তী ঐতিহাসিকরা ভুলক্রমে হোক কিংবা বিদ্বেষবশতঃ হোক এ আন্দোলনকে এই নামে পরিচিত করে তুলেছেন। এটা মূলতঃ এ আন্দোলনের বিরোধীদের পক্ষ থেকে গালি স্বরূপ ব্যবহার করা হয়। হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ এ সম্পর্কে বলেন, ‘ওয়াহ্হাবিয়্যাহ বিশেষণটি এ আন্দোলনের অনুগামীরা সৃষ্টি করেনি। বরং তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পৃথক করার জন্য এটা ব্যবহার করে যেন মানুষ তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে এবং শ্রোতারা মনে করে যে, এ আন্দোলন প্রচলিত বড় বড় চারটি মাযহাবের বিপরীতে পঞ্চম একটি মাযহাব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এ আন্দোলনের কর্মীরা নিজেদেরকে ‘সালাফী’ এবং তাদের দাওয়াতকে ‘সালাফী দাওয়াত’ বলে আখ্যায়িত করাকেই অধিক পসন্দ করতেন।’’১১ এই ঐতিহাসিক ‘ভুল’ অথবা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ অভিধাটি সারাবিশ্বে আজও পাকাপোক্তভাবে বিদ্যমান। ফলে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বের যে দেশেই ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলন তথা নিখাদ তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবানকারী আন্দোলন পরিদৃষ্ট হয়, সেখানেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিচ্ছিন্ন দল হিসাবে দেখানোর জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ ট্যাগ লাগিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়।
বর্তমান ওবামা প্রশাসনের কাউন্টার টেরোরিজম উপদেষ্টা Quintan Wiktorowicz তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা পেপার Anatomy of the Salafi Movement-এ লিখেছেন, ‘সালাফী মতবাদের বিরোধীরা প্রায়ই এ মতবাদকে বহিরাগত প্রভাবজাত মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে সম্বোধন করে। তাদের উদ্দেশ্য এই মতাবলম্বীদেরকে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের অনুসারী’ হিসাবে পরিগণিত করা। সাধারণতঃ যেসব দেশে সালাফীগণ সংখ্যায় স্বল্প এবং স্থানীয় অধিবাসীরা ধীরে ধীরে তাদের মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, সেসব দেশে তাদেরকে ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।১২ অনুরূপভাবে A. J. Arberry, George Rentz প্রমুখ প্রাচ্যবিদের গবেষণায় এবং স্বীকৃত কয়েকটি বিশ্বকোষে এই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করা হয়েছে।১৩প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের বিশেষ কোন নাম ছিল না। তবে সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আহবানকারী হিসাবে এটি পরবর্তীতে ‘সালাফী আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে।
পরিচয় :
১৭০৩ খৃষ্টাব্দে আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রভূমি নাজদ অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা যুগসংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ)। আরবের বুকে দীর্ঘকালব্যাপী জেঁকে বসা শিরক ও বিদ‘আতের বিপুল আস্ফালনকে রুখে দিয়ে অমাবস্যা রাতে ধূমকেতুর মতই চমক জাগিয়ে তিনি যে দুঃসাহসী আন্দোলন শুরু করেছিলেন; তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আরবের বুকে আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফে ছালেহীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের ভিত্তিতে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া নির্ভেজাল ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটান এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাদান। স্মর্তব্য যে, এটি আকস্মিক আবির্ভূত কোন আন্দোলন ছিল না; বরং ইসলামের ইতিহাসে অনুরূপ আন্দোলনের দৃষ্টান্ত অনেক। ইরাকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (৭৮০-৮৫৫ খৃঃ), সিরিয়াতে ইমাম আহমাদ ইবনে তায়মিয়া (১২৬৩-১৩২৮ খৃঃ), মিসরে ইয্ বিন আব্দুস সালাম (১১৮১-১২৬১ খৃঃ), মরক্কো ও স্পেনে ইমাম শাত্বেবী (১৩৮৮ খৃঃ), ইয়ামনে ইমাম ছান‘আনী (১৬৮৮-১৭৬৮ খৃঃ) প্রমুখ মহান যুগসংস্কারকবৃন্দ প্রত্যেকেই হক্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরূপ আন্দোলন-সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং খারেজী, মু‘তাযিলীসহ পথভ্রষ্ট আক্বীদাসমূহের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
মুসলিম বিশ্বে যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তারের কারণে এ আন্দোলন বিশ্ববাসীর নযরে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে জ্ঞানী মহল এ আন্দোলনের উপর বিশেষ গবেষণা চালিয়েছেন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হ’ল, সংস্কারধর্মী ও বিশুদ্ধবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে এ আন্দোলনের উপর পাশ্চাত্যের সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে নেতিবাচক বা ইতিবাচক যত গবেষণা হয়েছে, সম্ভবতঃ মুসলিম বিশ্বের ইসলামী কেন্দ্রগুলোতেও তত হয়নি। নিম্নে এ আন্দোলনের পরিচয় সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিতের বক্তব্য তুলে ধরা হ’ল-
১- মিসরীয় পন্ডিত ড. ত্বহা হুসাইন (১৮৮৯-১৯৭৩ খৃঃ) বলেন, ‘এই নতুন মাযহাবটি বাহ্যত নতুন মনে হ’লেও মর্মগতভাবে এটি সনাতনই। অর্থাৎ সমকালীন পেক্ষাপটে নবীন হ’লেও মৌলিকত্বের দিক থেকে এটি প্রাচীন। কেননা এ দাওয়াত ছিল বিশুদ্ধ, অবিমিশ্র এবং শিরক ও  পৌত্তলিকতামুক্ত আদি ইসলামের দিকে ফিরে যাওয়ার এক শক্তিশালী দাওয়াত। ... এটি ছিল স্বয়ং ইসলামের দিকেই দাওয়াত, যে দাওয়াত নিয়ে নবী করীম (ছাঃ) আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে শীর উঁচু করে থাকা যাবতীয় তথাকথিত মাধ্যমসমূহ উচ্ছেদের লক্ষ্যে। এ দাওয়াত পরিচালিত হয়েছিল আরবীয় ইসলামকে পুনরুজ্জীবন দান এবং অজ্ঞতা-মূর্খতা ও অনারব সংস্পর্শের প্রভাবজাত সৃষ্ট যাবতীয় ময়লা-আবর্জনাকে পরিশোধনের জন্য’।১৪ 
২- লেবাননী লেখক আমীর শাকীব আরসালান (১৮৬৯-১৯৪৬ খৃঃ) বলেন, ‘এই আন্দোলন ছিল সঠিক আক্বীদা, সালাফে ছালেহীনের নীতিমালা এবং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবাদের পদাংক অনুসরণের দিকে প্রত্যাবর্তনে আহবানকারী একটি আন্দোলন। যা কুসংস্কার, বিদ‘আত, গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা বা আনুগত্য প্রকাশ, কবরের প্রতি শ্রদ্ধা দেখান, আওলিয়ায়ে কেরামের অবস্থানস্থলে ইবাদত করা ইত্যাকার কার্যকলাপকে সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করে।১৫
৩- আমেরিকান পন্ডিত লোথ্রোব স্টোডার্ড (১৮৮৩-১৯৫০ খৃঃ) চমৎকারভাবে এর পরিচয় দিয়েছেন, ‘ওয়াহ্হাবী দাওয়াত একটি বিশুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারবাদী দাওয়াত। যার উদ্দেশ্য ছিল অলৌকিকতার ধারণাকে পরিশুদ্ধ করা, যাবতীয় অস্পষ্টতা, সন্দেহ ও কুসংস্কারের অবসান ঘটান। মধ্যযুগে ইসলামের মধ্যে তথাকথিত মুসলিম পন্ডিতরা যেসব বৈপরিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও পরস্পর বিরোধী সংযোজন ঘটিয়েছিলেন তা নাকচ করা এবং যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকান্ড ও ওলী-আওলিয়ার উপাসনাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করা। সর্বোপরি ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং আদি ও মৌলিক উৎসগুলোর মাধ্যমে ইসলামকে ধারণ করার আহবানই ছিল ওয়াহ্হাবী দাওয়াতের সারনির্যাস।
৪. ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উপর প্রথম তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনাদাতা সুইস পর্যটক জন লুইস বারখাডট (John Lewis Burkhardt) তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন, ‘ওয়াহ্হাবীদের ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহ নব্য কোন ধর্মবিশ্বাস ছিল না।...তাদের এবং সুন্নী তুর্কীদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, ওয়াহ্হাবীরা শরী‘আতকে কঠোরভাবে অনুসরণ করত, যখন অন্যরা তা অবহেলা করত অথবা পূর্ণাঙ্গভাবে তা অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকত’।১৬
মোটকথা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সর্বত্র একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, ওয়াহ্হাবী আন্দোলন মূলতঃ এমন একটি সংস্কারপন্থী ও বিশুদ্ধবাদী আন্দোলন, যা শিরককে সর্বতোভাবে বর্জনের মাধ্যমে নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতিষ্ঠাদানে সফল সংগ্রাম চালিয়েছিল এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছভিত্তিক প্রকৃত ইসলামী শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও নামধারী আলেম-ওলামা এবং বিদ্বেষী মহল প্রথম থেকেই হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ আনেদালনের বিরূদ্ধে কদর্যপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। তবুও এ আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীকে তারা বিন্দুমাত্র প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। বরং এ আন্দোলন বিগত তিন শতকে ইসলামকে শিরক ও বিদ‘আতের অশুভ ছায়া থেকে উদ্ধার এবং আদি ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষাকে পুনরায় বিশ্বের বুকে জাগ্রত করার এক অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের বুকে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছে নির্ভেজাল তাওহীদ তথা অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনাবিল সুবাতাস। বাতিলের কোটি কণ্ঠের সমবেত গর্জন, শত বাধার বিন্ধ্যচল এর অগ্রযাত্রায় যে কোনরূপ বাধা হ’তে পারেনি সেটাই সতত দৃশ্যমান। 
ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উৎপত্তি ও সমসাময়িক মুসলিম বিশ্ব : 
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের এই বরকতময় আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটেছিল মূলতঃ ১১৪৩ হিঃ মোতাবেক ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে। অতঃপর ১৭৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর আন্দোলন সারা আরবে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ক্রমশঃ জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।১৭ তিনি তাওহীদের পবিত্র দাওয়াত নিয়ে যখন আরব সমাজে নেমেছিলেন, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তখন মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অতীব নাজুক। সার্বিক অবস্থা ছিল এতই দুর্দশাগ্রস্ত ও কলুষিত যে, বহু ক্ষেত্রে তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছিল। নিম্নে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি সংক্ষিপ্তাকারে পেশ হ’ল।    
রাজনৈতিক অবস্থা :
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তুরস্কের ওছমানীয় খেলাফত, পারস্যের ছাফাভী এবং ভারতের মোগল-এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য।১৮
ওছমানীয় সাম্রাজ্য : প্রতাপশালী ওছমানীয় সাম্রাজ্যের শাসকগণ তখন এতই দুর্বল হয়ে পড়েন যে, তারা মন্ত্রী পরিষদ ও ভঙ্গুর সেনাবাহিনী প্রধানদের হাতের পুতুলে পরিণত হন, যারা রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মোটেও অভিজ্ঞ ছিলেন না। বিভিন্ন অঞ্চলে যারা গভর্নর হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন তারাও ছিলেন দুর্বলচেতা ও প্রশাসন পরিচালনায় অদক্ষ। জনগণের কাছ থেকে কর আদায় ছাড়া তাদের আর কোন চিন্তা ছিল না। সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ায় ওছমানীয় সাম্রাজ্য প্রায় সর্বদিক থেকে ইউরোপীয়দের কব্জাভূত হয়ে পড়ে এবং একের পর এক অঞ্চল ইউরোপীয়দের ভাগবাটোয়ারার শিকার হ’তে থাকে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত তিউনিসিয়া, আলজেরিয়াতেও বিরাজ করছিল একই অবস্থা। মরক্কোতে চলছিল সা‘দ বংশের শাসন। তারাও স্প্যানিশ ও পর্তুগীজদের হামলার ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকত। আর আরব ও বার্বারসহ বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধ তো লেগেই ছিল।
ছাফাভী সাম্রাজ্য : প্রায় আড়াইশ বছর রাজত্ব করার পর পারস্য তথা ইরানের ছাফাভী সাম্রাজ্য তখন আফগানদের দখলে চলে যায়। ১৭২৯ সালে ক্ষমতায় আরোহন করেন আফগান শাসক নাদির শাহ। তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে রাজত্বের সীমানা বাড়াতে থাকেন এবং আরব সাগর থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত তাঁর রাজত্বের সীমানা বিস্তৃত করেন। ১৭৪৭ তাঁর মৃত্যু হ’লে সাম্রাজ্য জুড়ে শুরু হয় বিশৃংখলা। ১৭৮৮ সালে কাজার বংশ ক্ষমতা দখলের আগ পর্যন্ত এই অরাজক অবস্থা চলতে থাকে।
মোগল সাম্রাজ্য : মোগল সাম্রাজ্যের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। আমীর-ওমারাদের গৃহযুদ্ধে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হ’তে থাকে। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরই মূলতঃ বৃটিশদের হাতে এর চূড়ান্ত পতন ঘটেছিল।
ধর্মীয় অবস্থা : 
মুসলমানদের ধর্মীয় অধঃপতনের সূচনা অবশ্য আরো কয়েকশত বছর পূর্বেই হয়েছিল, যখন মুসলিম সমাজে যিন্দীক তথা অন্তরে কুফরী গোপন রেখে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণকারী সম্প্রদায়ের উদ্রব ঘটে। ইসলামী খিলাফতের স্বর্ণযুগে এসব ভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যক্তিদের গোপন ষড়যন্ত্র এবং তাদের আমদানী করা বিষাক্ত চিন্তা-দর্শন ইসলামী আক্বীদা-আমলের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলিম সমাজ নানা ফেরকা ও মাযহাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে এই অধঃপতনের ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের পতন যখন আসন্ন হয়ে উঠে, তখন পরিস্থিতি হয়ে পড়ে আরো নাজুক। বিশেষতঃ আলেম-ওলামার মন-মগজে চেপে বসে এক ধরনের জমাটবদ্ধতা, কূপমন্ডকতা আর এক অন্ধ ঐতিহ্যপ্রিয়তা। আযহারী হোক বা হেজাযী হোক অধিকাংশ ওলামা এই দুর্দশায় নিপতিত ছিলেন।
ধর্মীয় এই অধঃপতনের পিছনে শাসকসমাজের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা কোনরূপ সংস্কারধর্মী ও সংশোধনমূলক চিন্তাকে স্বাগত জানাতেন না; বরং এরূপ চিন্তাধারার লোকদের তারা প্রায়শই কাফের বলে সাব্যস্ত করতেন। যেমনভাবে তারা ওয়াহ্হাবী আন্দোলনকেও ইসলাম বহির্ভূত সাব্যস্ত করেছিলেন। অথচ অপরদিকে তারা বিদ‘আতী ও ছূফীদের বিশেষভাবে প্রশ্রয়দান করেন, যাতে ছূফীদের প্রতি অনুরক্ত জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ফলে ছূফীবাদীরা একই সাথে শাসক ও জনগণের প্রশ্রয় পেয়ে তাদের বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমল প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র পেয়ে যায়। এমনকি তাদের কেউ কেউ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার দায়িত্বও পেয়ে যায়। এভাবে তাদের দৌরাত্ম্যে ওছমানীয় খেলাফতের সর্বত্র শিরক ও বিদ‘আতের বাধাহীন প্রসার ঘটে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো থেকে তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক আক্বীদা-আমল বিলীন হ’তে থাকে। বিভিন্ন দেশে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ওলী-আওলিয়াদের সুরম্য মাযার। এসব কবর-মাযারের প্রাচুর্য মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে সরিয়ে নিয়ে ওলী-আওলিয়ামুখী করে তুলে। আল্লাহর পরিবর্তে মাযারের ওলীর উপরই তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেখানে গিয়ে দো‘আ-দরূদ, নযর-নেওয়ায, কুরবানী ইত্যাদি পেশ করতে থাকে। আর নানা অলীক ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কারের তো কোন ইয়ত্তা ছিল না। ফলে কবর-মাযার সংস্কৃতির প্রভাব হেজায ও ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরাক, মিসর, পশ্চিম আফ্রিকা ও পূর্বপ্রাচ্য পর্যন্ত ইসলামী বিশ্বের সর্বত্রই বাধাহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে।১৯ মানুষ শিরক ও বিদ‘আতকেই ইসলাম ভেবে একনিষ্ঠতার সাথে পালন করতে থাকে। ফলে তাদের জীবনাচরণে তাওহীদ ও সুন্নাতের খুব সামান্য নিদর্শনই অবশিষ্ট ছিল।২০              
লোথ্রোব স্টোডার্ড সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে এভাবে চিত্রিত করেছেন, ‘দ্বীনে ইসলাম তখন হারিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ আবরণীর অন্তরালে। ইসলামের বার্তাবাহক রাসূল (ছাঃ) দুনিয়ার বুকে যে একত্বের নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন, তা আবৃত হয়ে পড়েছিল ছূফীবাদের খোলসে ও কুসংস্কারে বিস্তৃত চাদরে। মসজিদগুলো হয়ে পড়েছিল মুছল্লীশূন্য। সমাজে মূর্খ দ্বীন প্রচারক ও ফকীর-দরবেশের দল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যারা গলায় তাবীয-কবজ-তসবীহ ঝুলিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। তারা মানুষের মধ্যে মিথ্যা- অলীক, রহস্যময় সব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে তথাকথিত ওলী-আওলিয়াদের কবরে তীর্থযাত্রার জন্য প্ররোচিত করত এবং কবরে দাফনকৃত মানুষগুলোর শাফা‘আত বা সুফারিশ লাভের মিথ্যা প্রলোভন দেখাত।...খোদ মক্কা ও মদীনার অবস্থাও ছিল মুসলিম বিশ্বের আর সব এলাকার মতই। যে পবিত্র হজ্জকে আল্লাহ সামর্থ্যবানদের উপর অপরিহার্য করেছিলেন, তা নিছক এক ঠাট্টা-বিদ্রূপের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। মোটকথা মুসলমানরা আত্মপরিচয় হারিয়ে যেন পরিণত হয়েছিল অমুসলিমে। পতিত হয়েছিল অধঃপতনের অতল তলে। যদি ইসলামের বার্তাবাহক এই যুগে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতেন এবং ইসলামের এই দুরবস্থা দেখতেন, তবে অবশ্যই তিনি ক্রোধে ফেটে পড়তেন এবং এসবের জন্য যারা দায়ী, তাদেরকে মুরতাদ ও মূর্তিপূজকদের মতই লা‘নত করতেন।২১                
ড. মুহাম্মাদ আশ-শুওয়াঈর বলেন, এ আন্দোলন ছিল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এবং এ দুইয়ের বিপরীত যাবতীয় কিছু প্রত্যাখ্যানের নীতিতে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন আন্দোলন।২২ 

[চলবে]

. Syed Abdul Quddus, The Challenge of Islamic Renaissance, (Dehli : Adam Publishers, 1990), P. 17.
. প্রাগুক্ত, ১৭ পৃঃ।
. খায়রুদ্দীন আয-যিরিকলী, আল-আ‘লাম (বৈরূত : দারুল ইলম লিল মালায়ীন, ১৫তম প্রকাশ : ২০০২ খৃঃ), ৬/২৫৭ পৃঃ।  
. আহমাদ বিন হাজার আলে বুত্বামী, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, আক্বীদাতুহুস সালাফিয়্যাহ ওয়া দা‘ওয়াতুহুল ইছলাহিয়্যাহ ওয়া ছানাউল উলামা আলাইহে (কুয়েত : আদ-দারুস সালাফিয়্যাহ, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৮৩ খৃঃ), পৃঃ ১৩৫।
. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৫।
. ড. আমীনুল ইসলাম, ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম দর্শন (ঢাকা : উত্তরণ, ১ম প্রকাশ, ২০০৪ ইং) পৃঃ ২৩০।
.  ইয়াহইয়া আরমাজানী, মধ্যপ্রাচ্য অতীত ও বর্তমান, মূল : Middle East past and present, মুহাম্মাদ ইনাম-আল-হক অনূদিত (ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০০), পৃঃ ২৬০।
.  প্রটেস্টানিজম হ’ল ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় খৃষ্টসমাজে পরিচালিত একটি বিখ্যাত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, যা খ্যাতনামা সংস্কারক মার্টিন লুথার কিং তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চের পোপদের দুর্নীতি ও তাদের প্রবর্তিত ভ্রান্ত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন। ১৫১৭ সালে শুরু হয়ে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপ জুড়ে ছিল এ আন্দোলনের ব্যাপ্তি, যাতে এক বিরাট ধর্মীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
. Thomas Patric Huges, Dictionary of Islam (Delhi : Rupa & Co. 1988), P. 661.
১০. এটি একটি অপপ্রয়োগ   (misnomer)। কেননা আন্দোলনের উদ্গাতা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের নামেই যদি এই নামকরণ করা হয়ে থাকে, সে হিসাবে বড় জোর একে ‘মুহাম্মাদী আন্দোলন’ বলা যেত। কিন্তু অযৌক্তিকভাবে তাঁর পিতার নামানুসারে ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ নামকরণ করা হয়েছে। মাসউদ আলম নাদভীর মতে, প্রথম এ ভুলটি করেন John Lewis Burkhardt (১৭৮৪-১৮১৭ খৃঃ) নামক এক ইউরোপীয় পর্যটক। এরপর তা বিভিন্ন লেখকদের মাধ্যমে জনসমাজে প্রচার পায় (দ্রঃ মাসঊদ আলম নাদভী, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব : মুছলিহুন মাযলূমূন ও মুফতারা আলাইহ, উর্দূ থেকে আরবী অনুবাদ: আব্দুল আলীম আল-বাসতুভী (রিয়াদ : ১৪২০ হিঃ) পৃঃ ১৯৪; এ.জেড.এম শামসুল আলম, প্রবন্ধ : ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ও ওয়াহ্হাবী মতবাদ’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ঢাকা : ৪৪ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ২০০৫, পৃঃ ২১০।
১১. হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়েখ, প্রবন্ধ : আল-ওয়াহ্হাবিয়াহ ওয়া যাঈমুহা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, গৃহীত : ফরীদ ওয়াজদী, দায়েরাতু মা‘আরিফিল ক্বারনিল ইশরীন (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ৩য় প্রকাশ), পৃঃ ৮/৮২১। 
১২. Quintan Wiktorowicz, "Anatomy of the Salafi Movement" in "Studies in Conflict & Terrorism" USA, Vol. 29, Issue. 3 (2006), P. 235.
১৩. Encyclopedia of Islam and the Muslim World, Editor in Chief Richard C. Martin, V-2 (New York : Macmillan Referance, 2004), P. 727.
১৪ ত্বহা হুসাইন, আল-হায়াতুল আরাবিয়্যাহ ফি জাযীরাতিল আরাব (দামেশক : ১ম প্রকাশ, ১৯৩৫ খৃঃ), পৃঃ ১৩। গৃহীত : প্রবন্ধ ‘‘হাক্বীকাতুশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব’’, ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়াহ (রিয়াদ : ১৪০৮ হিঃ, ২১ তম সংখ্যা), পৃঃ ১২৭।
১৫. হাযেরুল ‘আলামিল ইসলামী, আরবী অনুবাদ : উজাজ নুয়াইহিয, সম্পাদনা : আমীর শাকীব আরসালান, মূল ইংরেজী : Lothrob Stoddard, The New World of Islam (P.1921) (বৈরূত : দারুল ফিকর, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৮৩ইং), ১/২৬৪ পৃঃ।
১৬. John Lewis Burckhardt, Notes on the Bedouins and Wahabys, (London : 282 Henry Colburn and Richard Bentley, 1830), P.275. গৃহীত : ‘আশ-শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতাহু ফির রু’য়াতিল ইসতিশরাক্বিয়া, নাছের বিন ইবরাহীম আত-তাওভীম (রিয়াদ : ১ম প্রকাশ, ২০০২ খৃঃ), পৃঃ ২৬।
১৭. শায়খ সালমান বিন সাহমান, আয-যিয়া আশ-শারেক ফি রাদ্দি শুবহাতিল মাযেক আল-মারেক (রিয়াদ : ইদারাতুল বুহূছ, ৫ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খৃঃ), পৃঃ ১০।
১৮.  ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, প্রবন্ধ : হাক্বীক্বাতু দাওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়াহ, পৃঃ ১২৮ ।
১৯. হুসাইন বিন গান্নাম, রাওযাতুল আফকার ওয়াল আফহাম (বাবাত্বীন : ১ম প্রকাশ, ১৩৬৮ হিঃ), ১/১০ পৃঃ।
২০. হাকীকাতু দা‘ওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, পৃঃ ১২৯।
২১. হাযেরুল ‘আলামিল ইসলামী, ১/২৫৯ পৃঃ।
২২. ড. মুহাম্মাদ আশ-শুওয়াঈর, তাছহীহু খাতাইন তারিখিইন হাওলাল ওয়াহ্হাবিয়া, পৃঃ ৬।

source:http://at-tahreek.com/june2011/2-5.html